রনির নতুন চাকরি। চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে চোখে অনেক রঙিন স্বপ্ন। এক
সঙ্গে অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে। সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিনের একদিন
বিশ্রাম নিলেও আরেক দিন ঘরে বসে থাকা দুরুহ। গাড়িতে দূরে কোথাও ঘুরতে
যাওয়ার ইচ্ছাই প্রবল। কিন্তু গাড়ি তো নেই!
রাতে খালামণিকে আব্দার জানালো গাড়ি লাগবে। খালামণি বিশেষ আপত্তি করলেন
না। তিনি ভাবলেন রনি কখনো কিছু আব্দার করে না। ও বেশ দায়িত্বশীল। নতুন
চাকরি হয়েছে। মাসের শেষ দিকে ড্রাইভারও মোটামুটি ফ্রি। খালামণির কাছে
এটুকু ইচ্ছা পূরণের আশা তো করতেই পারে।
গাড়ির ড্রাইভার বেলাল। একেবারে ঝানু এবং অনেকদিনের পুরানো ড্রাইভার।
রনির দুই বন্ধু ওর সঙ্গে যাবে। সমস্যা হচ্ছে রনির কাছে তেমন টাকা পয়সা
নেই। বন্ধুরা মিলে দূরে কোথাও ঘুরতে গিয়ে কিছু ভালমন্দ খাওয়া-দাওয়া তো
লাগেই।
অবশ্য পিয়াল রাজি হয়েছে দুপুরের লাঞ্চের দায়িত্ব নিতে। সাঈফ সন্ধ্যা
এবং বাসায় ফেরার পথে হালকা-পাতলা রনিই সামলে নেবে।
গাড়ি প্রথমে পিয়ালকে তুলবে। ও গুলশানে থাকে। ফুরফুরে মেজাজে গাড়িতে
উঠে মোবাইলে প্রিয় গানের বাছাই চলছে। রাস্তায় খুব একটা জ্যাম নেই। হঠাৎ
ঘ্যাচাং শব্দে রনির গান বাছাই বন্ধ হয়ে গেল! গাড়ি ও বাইকে সংঘর্ষ।
নির্ঘাত গাড়ির চামড়া উঠে গেছে! রনি গাড়ি থেকে নেমে এলো। বাইকে একটা
ছেলে বসা। রনির মেজাজ বিগড়ে গেছে। তাকিয়ে দেখল বাইকে বসা ছেলেটাকে।
একেবারে আনকোরা নতুন। টানা টানা চোখ। শুকনো গাল। শুকনা ও পাতলা ঠোঁট।
চেহারায় প্রচন্ড ভয়ের ছাপ। ঘন ঘন ঢোক গিলছে। দৃষ্টি স্বচ্ছ। দেখে মনে
হয় চোখের পানি ধরে রাখতে ওর কষ্ট হচ্ছে।
রনি নাম জিজ্ঞেস করল। 'সুবল, থাকি মন্দিরে, ঢাকায় নতুন, পকেটে টাকা নেই
- একনাগাড়ে কথাগুলো বলল ছেলেটা। কথাগুলো শুনে এবং ওকে দেখে রনির বিশ্বাস
হলো ঘটনা সত্যি। সুবলের দশ হাজার টাকা দেবার ক্ষমতা নাই - এ সুবল, থাকি
মন্দিরে, ঢাকায় নতুন, পকেটে টাকা নেই - একনাগাড়ে কথাগুলো বলল ছেলেটা।
কথাগুলো শুনে এবং ওকে দেখে রনির বিশ্বাস হলো ঘটনা সত্যি। সুবলের দশ হাজার
টাকা দেবার ক্ষমতা নাই - এটা তো পানির মতো সহজ সত্য। ওর চেহারায়
অপার্থিব সরলতা। মন্দিরে রাত কাটানো ছেলেটার কথার দাম আছে কিনা তা কীভাবে
যাচাই করা যায়-তাও ভাবনায় রাখা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা হলো রনির পকেট
শূন্য। সন্ধ্যার মধ্যে যেকোনো একটা ব্যবস্হাও হয়ে গেলে মন্দ কি!
নীতিটিথির কথা পরে ভাবা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সুবল নামের এই নিস্পাপ
ছেলেটা তো ঢাকায় একদিনও টিকে থাকতে পারবে। না। ওর একটা শিক্ষারও দরকার
আছে।
এসব অনেক চিন্তা একত্রিত করে সুবলের প্রতি কঠোর হলো রনি। কঠোর স্বরে বলল,
'রাত আটটার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা বিকাশে না পাঠালে সোজা গাড়ি চুরির
মামলা হবে।' আর যায় কোথায়! রবীন্দ্রনাথের ফটিক চরিত্রর মতো অতি সহজ-সরল
ছেলে সুবল মেনে নিল রনির আদেশ।
আদেশ জারি করে গাড়ির ছিলে যাওয়া চামড়াটা একনজর দেখে গাড়িতে বসল রনি।
ভাবছে সুবলের মতো একটা ছেলের কাছ থেকে না হয় পাঁচ হাজার টাকা আদায় করা
গেল! কিন্তু খালামণিকে কী বলবে! খালামণির চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।
পাশাপাশি মায়ের চেহারাটাও। রনি কল্পনায় মায়ের রাগী মুখটাকেই বেশি ভয়
পাচ্ছে। খালামণি উল্টা রনিকে না বকে তার বোনকেই রাগ কমানোর মেডিসিন
দেবেন। এমন খালা কার ভাগ্যে জোটে?
সারাদিন লং ড্রাইভে তিন বন্ধুর বেশ ভালো সময় কেটে গেল। এখন ফেরার পালা।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
এমন সময় মোবাইলে রিংয়ের শব্দ। রনি দেখল বিকাশ থেকে পাঁচ হাজার টাকা
প্রাপ্তির মেজেস। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না রনি। ওই গাধা ছেলেটা
পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। রনি তো ওকে জাস্ট ভয় দেখিয়েছে। ঘষা লেগে
গাড়ির সামান্য ক্ষতি হলে কেউ তো গাড়ি চুরির মামলা দেবে না। ওটা ছিল
নিছক একটা হুমকি। রনি মনে মনে বলল, আল্লাহ যাহা করেন, তাহা ভালোর
জন্যই
করেন।
দেরি না করে রনি বন্ধুদের বলল, এবার চল্ , পথে তোদের মশলাদার লেবুর
স্বাদের কোরাল মাছের ফিস ফ্রাই খাওয়াব। 'ওটা কোথায় পাওয়া যায়?'
পিয়াল আর সাইফের প্রশ্ন।
রনি হাসতে হাসতে বলল, 'গুলশানে।' ওরা অবাক হয়ে রনির হাসির কারণ খুঁজতে
লাগল।
*************************************
গল্পের ওপিঠ
আমার নাম সুবল। বাড়ি লালমনিরহাট। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বয়স উনিশ।
কাজের খোঁজে ঢাকা এসেছি। ঢাকার রাস্তাঘাট চিনি না। ঢাকায় এক বড় দাদার
বাসায় একদিন ছিলাম। তিনি একদিনের বেশি জায়গা দিতে পারলেন না। তাই বাধ্য
হয়ে মন্দিরে একরাত কাটিয়ে কাজের সন্ধানে রাস্তায় নামলাম। সহজ কাজ
হিসেবে 'পাঠাও' চালানো সিদ্ধান্ত নিলাম। লেখাপড়া তেমন জানি না। তাই এটাই
আমার জন্য ভালো হবে ভাবলাম। আবার সেই এক রাত জায়গা দেওয়া বড় দাদার
কাছে গেলাম। তার পরম যত্নের বাইকটা অর্ধ দিবসের জন্য ধার চাইলাম। তবে
নিশ্চিত ছিলাম তার বাইকটা পাওয়া দিবাস্বপ্ন। কিন্তু তিনি দিলেন, যা ছিল
আমার কল্পনার বাইরে। মনের আনন্দে গুলশানের দিকে গেলাম। সবকিছু ঠিকঠাকই
ছিল। হঠাৎ ঝকঝকে একটা গাড়ির বডিতে বাইকটা গ্যাচ করে লেগে থেমে গেল।
সামনে জ্যাম। গাড়িটা আস্তে আস্তে থামানো চেষ্টারত অবস্থায় ঘটনাটা ঘটে
গেল। চোখের পলকে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে এলেন একজন স্মার্ট তরুণ।
আমি সুবল, গ্রাম থেকে সদ্য এসেছি, পকেটে টাকা নেই, রাত কাটিয়েছি
মন্দিরে, চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলাম। গাড়ির বডিতে ঘষা লাগা জায়গাটা
গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। ধীরে ধীরে চেহারাটা কালো মেঘের রূপ
ধারণ করলো।
'এ্য ছেলে কি হলো? তুমি তো আমার গাড়ির বারোটা বাজিয়ে দিলে।' তোমার
লাইসেন্স বের করো। ফটাফটা লাইসেন্সের ছবি তোলা হলো। এন আই ডি এর ছবিও বাদ
গেল না। আশে পাশে কোন ট্রাফিক পুলিশ নেই। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে
তাকিয়ে রইলাম। হুস ফিরে এলো যখন কানে ভেসে এলো এক কঠিন আদেশ।
' দশ হাজার টাকা বের করো।' তরুণের আদেশ।
আমি আর্তচিৎকার দিলাম। 'কি ইইইইই?'
'বলছি গাড়িতে ঘষা লাগছে। গাড়ির চামড়া উঠে গেছে। নতুন চামড়া লাগাইতে
টাকা লাগবে। কমপক্ষে দশহাজার। টাকা বাইর করো।' তরুণের কটাক্ষ।
'আমি টাকা কোথা দিয়া দিব? পকেটে মাত্র একহাজার টাকা এবং খুচরা কিছু
পয়সা আছে।'
'থাকো কোথায়?' তরুণের প্রশ্ন।
'মন্দিরে।' আমি বললাম।
'টাকা দিতেই হবে। যেখানেই থাকো টাকা না দিয়ে এক পাও নড়তে পারবে না।
তাইলে পুলিশের হাতে তুলে দেব।' তরুণ আরও কঠোর।
'স্যার, মাফ করেন। টাকা নাই।'
আচ্ছা পাঁচ হাজার দাও। পাঁচ হাজার মাফ করলাম।
আমি কাঁদতে শুরু করলাম। 'স্যার ঢাকা শহরে আমার কেউ নেই।' খেয়াল করলাম
চারপাশের গাড়ি থেকে লোকজন আমাদের দেখছে। আমি যে অপরাধী তাও সবাই বুঝে
গেছে। বাধ্য হয়েই বললাম, ঠিক আছে স্যার। কিন্তু এখন আমার কাছে কোনো টাকা
নেই। বাসায় গিয়ে আপনাকে বিকাশ করে পাঠাবো। তরুণ স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে
থেকে বললেন, 'যদি হেরফের হয়, তাইলে তোমার সব কাগজপত্র আমার কাছে আছে।
সোজা মামলা করবো। গাড়ি চুরির মামলা। তখন দশ হাজার না, বিশ হাজার গোনা
লাগবে।'
তারপর আমার দিকে এক দুর্বোধ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাড়ির ঘষা খাওয়া
জায়গাটা আর এক বার দেখে গাড়িতে উঠে গেলেন।
আমি কোনোমতে মন্দিরে ফিরে বাবাকে ফোন দিলাম। বললাম, 'বাবা তোমার জমি বেচা
টাকা দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাও। নাইলে আমার জেলের ভাত খাওয়া লাগবে।
টাকাটা আজই পাঠাও।' আমার বাবা শিবনাথ সহজ-সরল মানুষ। এক টুকরা জমি ছিল।
আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে দিতে শেষমেষ জমিটা বিক্রি করতে হয়েছে। সেই টাকা
দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা সুবলের জেলে যাওয়া ঠেকাতে পাঠাতে হবে। কেন, কি
কারণে জেলে যাবে তা কিছুই বোঝা গেল না। তিনি অল্পতে অস্হির হওয়া মা
সুমিতা দেবীকে ঘটনাটা না বলা ঠিক করলেন। সুবলের চিন্তায় এমনিতেই আধামরা
অবস্হা সুমিতার। আমি বাড়ি ফিরলেই সব ঘটনা শোনা যাবে। এ সব ঢিন্তাভাবনা
করে বাবা শিবনাথ পাঁচ হাজার টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দিলেন সন্ধ্যার মধ্যে।
এরপর এতগুলো টাকার শোকে বোবা ব্যথা নিয়ে আমার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়
রইলেন।
আমি দুঃখী বাবার পাঠানো টাকা পেয়ে বার বার নিজেকে গালি দিতে লাগলাম।
কিন্তু কারো সঙ্গে কথা না বলে ওই তরুণ স্যারের মোবাইলে পাঁচ হাজার টাকা
পাঠিয়ে দিলাম। তারপর ভাবলাম এই ঢাকা শহর আমার জন্য না। তারচেয়ে বাড়ি
ফেরাই পরবর্তী বিপদে পড়া থেকে আমাকে রক্ষা করবে। সারারাত ঘুমাতে পারলাম
না। এই ঘটনা আমার মাথার কোষে কোষে হাঁটা-চলা শুরু করেছে। তিলে তিলে আমাকে
কষ্ট দিচ্ছে। একমাত্র বাড়ি ফিরে গেলেই শান্তি পাব- ধীরে ধীরে এই স্বপ্ন
নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন বাড়ি ফিরে গেলাম। বাবা শিবনাথ কিছু বলার রুচি হারিয়ে ফেলেছেন বলে
মনে হলো। মা সুমিতা দেবী এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কারণ উদঘাটনে ব্যর্থ
হয়ে অনেকক্ষণ গজগজ করে এক সময় থেমে গেলেন। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো।
কিন্তু ঘটনাটি শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।
সাতদিন পরের কথা। আমার মোবাইলে একটা টু টু শব্দ। একবার তাকিয়ে চোখ
ফিরিয়ে নিলাম। আবার মোবাইলে শব্দটা হলো। এটা তো বিকাশে টাকা আসা জাতীয়
শব্দ। হাতে নিয়ে দেখলাম কেউ আমাকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। সাথে
একটা মেসেজ। পড়তে শুরু করলাম:
'টাকাটা ফেরত দিলাম। ঢাকা শহরে থাকতে হলে প্রথমেই তোমার একটা কঠিন
শিক্ষার দরকার ছিল। আমি সেই শিক্ষাটা দিলাম। যাতে ভবিষ্যতে এই কঠিন শহরে
টিকে যেতে পারো।'
টোনা আর টুনি দুই ভাই বোন। পিঠাপিঠি ভাই-বোন। ওরা সারাক্ষণ একসাথে থাকে।
একই ক্লাসে পড়ে। তবে টুনি টোনার চেয়ে এক বছরের ছোট। দুজনার খুব মিল।
স্কুলে একসাথে যায়। একসাথে খেলে। একসাথে ঝগড়া করে। ওদের আর কোন বন্ধুর
প্রয়োজন হয় না। মা-বাবার চোখের মণি ওরা। টোনা টুনির বাবা ঢাকা থেকে
বরিশালে বদলি হয়েছেন। তিনি সরকারি অফিসে চাকরি করেন। বাসার কাছে একটি
স্কুলে টোনা টুনিকে ভর্তি করা হলো। স্কুলের নাম ছোটদের মণিমিতা স্কুল।
নতুন স্কুল। এই স্কুলের টিচারদের টোনা টুনির খুব ভালো লাগে। তারা সব সময়
হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলেন। কখনো রাগ করেন না। দুষ্টুমি করলে কোন
মারপিট নেই। এই স্কুলের শাস্তির ধরনটা একটু ভিন্ন। এমন শাস্তি পেতে হয়
যা মারপিটের চেয়েও কঠিন। সেদিন টুনি এ রকম একটা শাস্তি পেয়েছিল।
স্কুলের বাগান থেকে ফুল ছেঁড়া নিষেধ জেনেও টুনি একটা ফুল ছিঁড়ে
ফেলেছিল। সাথে সাথে টুনির জন্য শাস্তির হুকুম জারি হলো। টুনিকে একশত বার
লিখতে হয়েছিল 'কখনো ফুল ছিঁড়বো না।' সব ক্লাস শেষ হবার পর শাস্তির
ক্লাস শুরু হয়। একশত বার 'কখনো ফুল ছিঁড়বো না।' - এ লাইনটি লেখা শেষ
হলে তবেই ছুটি মেলে। তাও আবার শাস্তি পাওয়া লাইনটির লেখা সুন্দর হওয়া
চাই। এ ধরনের শাস্তির কারণে স্কুলের সবার হাতের লেখার বেশ উন্নতি হয়েছে
বলে শোনা যায়। টোনা টুনি ক্লাস সেভেনে পড়ে। টুনির অংকে ভীষণ ভয়। অঙ্ক
ক্লাসের টিচার আসার সাথে সাথে টুনির ভয়ে গলা শুকিয়ে যায়। ঢাকার স্কুলে
ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষায় অঙ্কে কোনো রকম টেনেটুনে পাশ করেছে টুনি।
কিন্তু টোনা অঙ্কে বেশ ভাল। টোনার অঙ্কের নম্বর দেখে টুনি আরও ঘাবড়ে
যায়। বরিশালে নতুন ক্লাস সেভেন।
সেভেনে নতুন অঙ্কের টিচার ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে টুনার মনে হলো জানালা দিয়ে
লাফিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু তার উপায় নেই। হতাশ চোখে টুনি নতুন
টিচারের দিকে তাকিয়ে রইল। অঙ্ক টিচার এসে চেয়ারে বসেই গল্প শুরু করে
দিলেন, যেন তিনি গল্প বলার টিচার। কী অদ্ভুত! টিচার সবার নাম জেনে নিলেন।
তারপর কে কি খেতে ভালবাসে, কার কোন্ রঙ পছন্দ ইত্যাদি গল্প করতে করতে
ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে যাবার পালা। সবাই বেশ মজা পাচ্ছে। সবচেয়ে মজায়
আছে টুনি। একটু আগে যে ক্লাস থেকে পালাতে চাইছিল সেই-ই কিনা এখন ক্লাসটা
শেষ না হবার জন্য মনে মনে সময় গুনছে। টোনার চোখ গেল টুনির দিকে। টোনাও
বেশ খুশি টুনির হাসিভরা মুখ দেখে। অঙ্ক টিচার বিদায় নেবার আগে শুধু
বললেন, 'আগামীকাল অংক ক্লাসে তোমাদের সঙ্গে মজার খেলা হবে। অঙ্ক নিয়ে
তোমাদের যত প্রশ্ন, স্বপ্ন, চিন্তা, ঘটনা কিংবা ভয়ভীতি যা কিছু আছে তাই
নিয়ে ক্লাসে আমরা সবাই মিলে রোল প্লে করবো। ক্লাসে সবার মধ্যে একটা
উত্তেজনা দেখা গেল। প্রথম দিনের অংক ক্লাসটা শেষ হয়ে গেল। কিন্তু
ক্লাসের রেশটা রয়ে গেল অনেকক্ষণ। টুনি মনে হলো ক্লাস সেভেনে সে অংকে ১০০
তে ১০০ পাবে।
টোনা টুনি ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেটের কাছে এলো। গেট থেকে সবাই বেড়িয়ে
পড়েছে। সবাই যার যার বাসায় যাচ্ছে। গেটে একজন পাহারায় বসে আছেন। সবাই
তাকে টারজন বলে ডাকে। টারজন সবার মাথা গুনে স্কুলে ঢোকানোর কাজটি খুব
সুচারুভাবে করে। খুব হাসি-খুশি স্বভাবের একজন পাহারাদার। নতুন কেউ স্কুলে
ভর্তি হলে তাকে বাসার ঠিকানায় রিক্সা করে দেবার দায়িত্বও মিস্টার
টারজনের। টোনা টুনিকে কয়েক দিন ধরে রিক্সা করে দিচ্ছে টারজন। স্কুলে
ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি না। টারজন মোটামুটি সবাইকেই চেনে। টুনি আজ
টারজনকে বললো, 'টারজন ভাইয়া আজ আমরা রিক্সা করে নিজেরাই যেতে পারবো।'
টোনা টুনি গেট থেকে বেড়িয়ে রিক্সায় না ওঠা পর্যন্ত টারজন দূর থেকে
ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
টোনা টুনি বাসায় ফিরে মা বাবাকে প্রতিদিন স্কুলের গল্প করে। আজ টুনির
গল্প শুধু অঙ্ক ক্লাস নিয়েই আটকে থাকলো। মা-বাবা বুঝে নিলেন টোনা টুনির
অংকের টিচার খুব বুদ্ধিমান। প্রথম ক্লাসেই ছেলেমেয়েদের অংক ভীতি দূর
করার জন্যই এমন গল্পের আসর বসিয়েছেন তিনি। মা-বাবা ওদের গল্প শুনে বেশ
উৎসাহিত হন। বদলির চাকরি। তাই নতুন কর্মস্হলে না এসেও উপায় নেই। ঢাকা
ছেড়ে আসার আগে টোনা টুনির স্কুল ও পড়াশোনার বিষয়টি মা-বাবাকে সবচেয়ে
বেশি চিন্তিত করেছিল। এখন তাঁরা কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সামনে ২৬শে
মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। এ দিবস উপলক্ষে আন্ত-স্কুল রচনা
প্রতিযোগিতা হবে। এই প্রতিযোগিতায় টোনা টুনি অংশ নেবে। মা-বাবা এ কথা
শুনে রীতিমতো অবাক। আগে কখনো টোনা টুনির মধ্যে এমন প্রতিযোগিতায়
অংশগ্রহণের কথা শোনা যায়নি। এ সব কথা শুনে তারা আনন্দে আত্মহারা। তাঁরা
ভাবলেন এত দিনে টোনা ও টুনির পড়াশুনা নিয়ে দুশ্চিন্তার অবসান হলো।
এর মধ্যে ঘটলো আরেক ঘটনা। সেদিন যথারীতি টোনা টুনি স্কুলে গেল। সিঁড়ি
দিয়ে উপরে ওঠার সময় ওদের চোখে পড়লো সিঁড়ির মাথায় একটা বড় সাইজের
ব্ল্যাকবোর্ড। ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু একটি লেখা। ওরা কাছে গিয়ে দেখলো
ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা আছে 'সৎকর্ম যতই ছোট হোক, তা কখনো বৃথা যায় না।'
ওদের মনে হলো পিছনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। ওরা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো
একজন সিনিয়র আপা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, 'আমার নাম রূপা। আমি ক্লাস
টেন এ পড়ি। তোমরা তো টোনা টুনি তাই না?' ওরা মাথা নেড়ে বললো, 'জ্বী।'
টোনা জিজ্ঞাসা করলো, 'আচ্ছা ব্ল্যাক বোর্ডে এ কথা লেখা কেন?' রূপা বললো,
'প্রতি সপ্তাহের জন্য মণিষীদের একটি উক্তি এখানে লেখা হয়। আমরা যাতে এ
থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। পরবর্তী সপ্তাহে এখানে লেখা থাকবে অন্য
কোনো মণিষীর উক্তি। ক্লাসে যাবার সময় তোমাদের এ লেখাটি চোখে পড়বে।'
টুনি বললো, ' আপু, আমি কি এখানে লিখতে পারবো? 'নিশ্চয়ই পারবে।' বললো
রূপা। 'তবে এখানে তারাই লিখতে পারে যাদের হাতের লেখা সুন্দর।' টুনি একটু
চিন্তায় পড়ে গেল। এর মধ্যে ঘন্টা পড়ে গেল। ওরা ক্লাসের দিকে জোরে
হাঁটা শুরু করলো। ক্লাসরুমে ঢুকে ওরা অবাক। ক্লাসের সবচেয়ে ছোট্ট
মেয়েটি টিচারের চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। টিচার এখনো আসেননি।
ওর কথা শোনার জন্য টোনা টুনি ওদের নির্দিষ্ট ডেক্সে বসে পড়লো। মেয়েটির
নাম রোহা। রোহার কথা অনুযায়ী সে আগামী দুই দিনের জন্য ক্লাস ক্যাপ্টেন।
সবাইকে হাজিরা খাতায় নাম লেখা, নিজ নিজ ডেক্স পরিষ্কার করা, সবার
বই-খাতা কলম-পেন্সিল ঠিক আছে কিনা তা চেক করার কথা মনে করিয়ে রোহা নিজের
সিটে গিয়ে বসলো। রোহার কথা মতো সবাই নিজেদের হোম-ওয়ার্ক থেকে শুরু করে
সবকিছু ঠিকঠাক করে টিচারের অপেক্ষায় শান্ত হয়ে বসে রইলো।
এদিকে প্রথম ক্লাস ইংলিশ সাবজেক্টের। টোনা অঙ্কে ভালো হলেও ইংলিশে কাঁচা।
কিন্তু ইংলিশ ক্লাসের টিচার বেশ অমায়িক এবং শান্তশিষ্ট। তাঁকে দেখে টোনা
নিশ্চিন্ত হলো। অন্ততঃ ক্লাসে সবার সামনে গ্রামারের কঠিন শর্ত না বলতে
পারলে অপমানিত হতে হবে না। টিচারের প্রথম কথা হলো, 'ইংলিশ আমাদের ভাষা
নয়, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। কাজেই ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে কম চিন্তা,
বেশি প্রাকটিস। তোমরা কথা বলবে ইংলিশে, গল্প করবে ইংলিশে, এমনকি স্বপ্ন
দেখবে ইংলিশে। তাহলেই এ ভাষা তোমাদের কাছে সহজ হয়ে যাবে। আর ইংলিশ
ল্যাঙ্গুয়েজ শেখার অভিযানে আমি তো তোমাদের সঙ্গেই আছি।' টোনা অবাক।
ইংলিশে স্বপ্ন দেখা সেটা আবার কী! এমন অদ্ভুত কথা টোনা কখনো শোনেনি। টুনি
কৌতুহলী চোখে ইংলিশ টিচারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্কুলের ছুটি শেষে দুই
ভাই-বোন ইংলিশ টিচারের এ কথা নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে বাসায় পৌঁছে
গেল। মা-বাবা কাছেও বলা হলো ইংলিশ টিচারের গল্প। এসব নতুন নতুন কথা শুনে
মা-বাবাও বেশ খুশি।
নতুন স্কুলে প্রতিদিই ওরা নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করতে লাগলো। একদিন
টুনি পানি খেতে ক্লাসের বাইরে এলো। ঠিক সে সময় ঢং ঢং ঢং শব্দে ঘন্টা
বেজে উঠলো। কিন্তু টুনি দেখলো ঘন্টা বাজিয়ে চলছে একটি লম্বাটে ছেলে।
টুনি কৌতুহল চেপে রাখতে পারলো না। টুনি জানতে চাইলো, ' এ স্কুলে ঘন্টা
পেটানোর লোক নেই?' তখন লম্বাটে ছেলেটি বললো, 'এ স্কুলে নিজের কাজ নিজে
করতে হয়।' আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের ক্লাসে একটি ঘড়ি রাখা আছে।
সময় দেখে আমি ঘন্টা বাজাই। তবে অন্য লম্বা ছেলে-মেয়েদের সুযোগ আছে
ঘন্টা বাজানোর। তুমি ক্লাস নাইনে উঠলে তুমিও ঘন্টা বাজাতে পারবে। টুনি
খেয়াল করলো ঘন্টাটা একটু উঁচু জায়গায় রাখা হয়েছে। টুনি ক্লাসে চলে
গেল। ক্লাস শেষে টোনাকেও ঘন্টা কাহিনি জানালো টুনি।
স্কুল ভালো লাগার সঙ্গে সঙ্গে এ স্কুলের টিচারদেরও অনেক ভালো লাগতে শুরু
করে ওদের। এ স্কুলের টিচার এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক
রয়েছে। কোন ধরনের বকাঝকা ছাড়াই এক অদৃশ্য যাদুমন্ত্রে শিক্ষার্থীরা
নিজেকে টিচারের সামনে ভালো ছাত্র হিসেবে প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
সবার মধ্যে কে কত ভালো করতে পারে-এমন একটা নীরব প্রতিযোগিতা চলতে থাকে।
যে যত ভালো করবে, টিচারের ভালোবাসার ফল্গুধারা তাদের প্রতি তত বেগে
প্রবাহিত হতেই থাকবে।
দেখতে দেখতে টোনা টুনির এ স্কুলে তিন বছর কেটে গেল। স্কুলের আরও উন্নতি
হয়েছে। কম্পিউটার এসেছে। নতুন নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের কলকাকলিতে মুখরিত
হয়ে উঠেছে স্কুল প্রাঙ্গণ। খেলা মাঠ প্রশস্ত হয়েছে। টোনা টুনি ভাল
ফলাফল নিয়ে ক্লাস টেন এ উত্তীর্ণ হয়েছে। সব ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। কিন্তু
এর মধ্যে টোনা টুনির বাবার ঢাকা বদলির খবরে ওদের মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
বাবা শুধু বললেন, 'বদলির চাকরি। যেতে হবে।' মা সান্তনা দিয়ে বললেন,
'ঢাকায় তোমাদের অনেক ভালো স্কুলে ভর্তি করে দেব।' টোনা টুনি বললো, যেতেই
হবে? স্কুলের সব ভালো লাগার পরিবেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতেই টোনা টুনির
চোখ ভরে পানি টলমল করতে লাগলো। মা-বাবার মাথায় কোনো আইডিয়া আসছে না।
তখন টৌনা টুনিই সমাধান দিল, 'স্কুলের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার
ব্যবস্হা থাকলে অথবা বাবা যদি বদলি না হতেন তাহলে আমরা এখানেই পড়াশোনা
করতে পারতাম।' বাবা বললেন, ভবিষ্যতের জন্য এ পরামর্শ আমরা স্কুল
কর্তৃপক্ষ ও আমাদের অফিসে জানিয়ে রাখবো।
রিমঝিম বৃষ্টির জন্য শুধু অপেক্ষা। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। আকাশে
মেঘের আনাগোনা নেই।
পাশাপাশি অনেকগুলো টিনের ঘর।
টিনের ঘরগুলো সব আগুনের চুল্লির মতো তাপ ছড়াচ্ছে। রুবি চোখ বন্ধ করে
মেঝে বসে আছে। সেই কবে থেকে রুবি বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছে তা ওর মনেও
নেই। রুবি নিজের জন্য বৃষ্টির অপেক্ষা করছে না। ওর মায়ের জন্য বৃষ্টি
দরকার। কিন্তু বৃষ্টি নামার কোনো লক্ষণ নেই। রুবি পুরনো টিভির দিকে
তাকিয়ে ভাবলো আবহাওয়ার খবর দেখবে। পরে তাও আর দেখলো না। কারণ,
আবহাওয়ার সংবাদে নতুন কিছু নেই বলেই ওর মন বলছে।
গতকাল রাতে দাদাজানের সঙ্গে রুবির কথা হয়েছে। দাদাজানের গলা ছিল শুকনো।
মনে হলো কত জনম দাদাজান পানিতে গলা ভেজান নি। ক্লান্ত স্বরে দাদাজান বৌমা
আছিয়ার শরীরের খবর নিয়ে বললেন, ' মায়ের দিকে খেয়াল রাইখো কিন্তু।
চারিদিকে খরা। জমিতে ফসল নাই, সূর্য মাটিতে নাইমা আইছে । নদী মইরে গেছে।
মানুষের ঘরে খাওন নাই।' রুবি শুধু বলল, 'আইচ্ছা দাদাজান। এইটুকু বলতে না
বলতে মোবাইল ফোনটি বন্ধ হয়ে গেল। রুবির মোবাইলের ব্যালান্স শেষ। ফোনটা
আসলে রুবির না। ময়না খালার। মায়ের শরীর খারাপ বলে দ্রুত যোগাযোগ করার
জন্য রুবির কাছে দিয়ে রেখেছে। একটা গোঙরানির মত আওয়াজ শুনে রুবি দৌড়ে
শোবার ঘরে উঁকি দিল। মা, আছিয়া বেগম হাঁসফাঁস করছে। পাশ ফিরে শুতে
চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। রুবি ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে মাকে পাশ
ফেরানোর চেষ্টা করছে। ভীষণ অসহায় লাগে রুবির। মাকে পাশ ফিরে শোয়ানো
মাত্রই মায়ের মুখ দিয়ে গাল বেয়ে ঘোলাটে পানি পড়তে লাগলো। মাথার উপরের
ফ্যানটা খুব জোরে ঘুরছে। মায়ের কপালের চুলগুলো সব ঘামে ভেজা। ঠিক এসময়
বিড়ালের মিউ মিউ শব্দে মায়ের চোখ একটু খোলা দেখে রুবি ওর মায়ের মুখের
উপর ঝুঁকে পড়লো। বললো, 'মা কেমন লাগে? খালারে ডাকুম?' দুই সন্তানের
জননী, একুশ বছরের শরীরে সংসারের ঝড়ঝাপটার চিহ্ন স্পষ্ট, শ্যামনগরের লোনা
পানিতে বসত করা মনু মিয়ার বৌ আছিয়া বেগম ক্ষীণ স্বরে বললো, 'দ্যাখতো
বিলাইডা কান্দে ক্যা, ওরে খাইতে দে মা'। নিজে বাঁচে না, আবার বিলাইর খবর
নেয় - মায়ের উপর মনে মনে চটে রুবি। কিন্তু ওর ছোট্ট মনে মা ও বিড়ালের
অবস্থা একই রকম মনে হয়। মা আর বিড়াল এ দুটি প্রাণই এখন মৃত্যুর সঙ্গে
যুদ্ধ করছে। গরমে তাপদাহে গত বছরও ওদের গ্রামে রহিম চাচার ছোট মেয়ে লেবু
মারা গেছে। গরমে মেয়ে মারা গেছে এ যেন কেউ বিশ্বাস করতে চায় নি। রুবির
সে ঘটনার কথা বেশ মনে আছে।
ওদের টিনের ঘরের পাশে খড়কুটোর স্তূপের যে পাশে একটু ছায়া ছায়া সে
দিকটায় বিড়ালটা শুয়ে আছে। এই বিড়ালের মোটা পেটটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে
ওঠানামা করছে। রুবি বিড়ালটার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কয়দিন
ধরে বিড়ালটা বেশি বেশি খাচ্ছে বলেই পেটটা এমন মোটা মোটা লাগছে। কিন্তু
রুবি অবাক হয়ে ভাবলো ওর মা অসুস্থ হয়ে শুয়ে পড়ার পর বিড়ালকে কেউ
খাবার দেবার নেই। তাহলে এই ধুসর বর্ণের বিড়ালটা কী খেয়ে এত মোটা হলো।
হঠাৎ রুবির মনে হলো ছোট চাচার মেয়ে মিলুর বিড়ালপ্রীতির ঘটনা। এই ধুসর
বর্ণের বিড়ালটার নামটা মিলুই রেখেছে 'রানী'। রানীর প্রতি মিলুর অনেক
মায়া। রুবির কাছে বিড়ালের দিন দিন মোটা হবার কারণটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
এবার রুবি উঠানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে দাদাজানের
সেই গানটা গুণগুণ করে গাইতে লাগলো। 'আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে
তুই আল্লাহ মেঘ দে।' আকাশটা ফকফকা রোদে ভরা। রুবি গুণগুণ গানের সুরটা
বাড়িয়ে দিল। ওর কণ্ঠের গান টিনের ঘরগুলোর সেদ্ধপ্রায় মানুষজনকে
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুরের যাদুমণ্ত্রের মতো ঘরের দরজায়
হাজির করলো। ওর বয়সী গোটা পাঁচ/ছয় ছেলেমেয়ে রুবির সাথে গান ধরলো। এ
গান ওই গ্রামে কম বেশি সবার জানা। রোদের তেজ আর ওদের গলার তেজ একাকার
হয়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়লো। রুবির ছোটভাই পিনু সারাদিন উঠানের লোনা পানিতে
লাফালাফি করছিল। রুবির দেড় বছরের ছোট ভাইটি মায়ের জন্য চেয়ারম্যান
বাড়ির ডিপ টিউবওয়েলের পানি আনতে গিয়ে হতাশ হয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছে।
টিউবওয়েলের পানিও এখন লবনাক্ত। কোথায়ও মুখে দেবার মত একফোঁটা পানি নেই।
উঠানের জমে থাকা লোনা পানিতে পুঁইশাক, লালশাক আর কাঁচা মরিচের গাছগুলো
ঢলে পড়েছে। একমাত্র ঝমঝমিয়ে নেমে আসা বৃষ্টি হলেই এই চরম কষ্টের হাত
থেকে গ্রামের মানুষ রক্ষা পাবে। তাইতো ওরা গলা ছেড়ে চিৎকার করে গান
গাইছে। রোদে ওদের শরীর পুড়ে যাচ্ছে। গান গাওয়া ছেলেমেয়েদের বাবা-মা
যেন এ দৃশ্য সহ্য করতে পারছেন না। তাই তারাও নেমে এলেন উঠানে।
ছেলে-মেয়েদের আঁচল দিয়ে ঢেকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার কত চেষ্টা তাদের । গান
থেমে গেল। রুবি আর পিনু সোজা মায়ের বিছানায় গিয়ে বললো, 'দেইখো আইজ
সাঁইঝের মধ্যেই বৃষ্টি আইবো। আমরা বৃষ্টির গান গাইয়া মেঘের মন ভুলাই
দিছি।' আছিয়া বেগম ঘোলা ঘোলা চোখে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'গত
বছর গেল ঝড় বৃষ্টি আর এ বছর খরা। দুনিয়াটার কী হইলো রে!' আমাগো
ছোটবেলাডা কত ভালা ছিল।' এ কথা বলে রুবির মা বিড়বিড় করতে লাগলো। রুবির
ওর আব্বুর কথা মনে পড়লো। আব্বুর কথা ভাবতেই ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।
মানুষটা সংসারের সব দায়িত্ব মায়ের উপর ফেলে সেই কবে যে ঢাকা শহরে গেছে
আর আসার নাম নেই। মাঝে মধ্যে কিছু টাকা-পয়সা পাঠায়। এ পর্যন্তই। পিনু
মাকে সান্ত্বণা দেবার চেষ্টায় বললো, ' আইজ ঢাকা থাইক্যা বিদেশিরা আইছে।
বিদেশিরা চেয়ারম্যান চাচার লগে অনেক মজার মজার গল্প কইতে ছিল।' 'কী গল্প
রে ভাই।' জানতে চাইলো রুবি। 'চীন দেশের মানুষরা নাকি আকাশ দিয়া নিজেরাই
বৃষ্টি নামাইতে পারে। তারা আকাশে মেঘ তৈরি করার বুদ্ধি জানে। ছোট ছোট
মানুষগুলার অনেক বুদ্ধি। সবকিছুর জ্ঞান আবিষ্কার কইরে ফেলছে। 'কী মজা ঠিক
না বুবু?' রুবি এমন অদ্ভুত কথা আগে কখনো শোনেনি। ও শুধু বললো, ' এগুলা
কথার বিশ্বাস নাই।' কিন্তু পিনু একটানা বকবক করেই চলেছে। 'আচ্ছা ধরো বুবু
এমন যদি হয় এই তেজি রোইদগুলারে আমরা কোন বাক্সে আটকাইয়া রাখার বুদ্ধি
পাইয়া যাই?' রুবির কাছে পিনুর এসব কথা স্রেফ পাগলের বকবকানির মতো মনে
হলো। রুবি বললো, 'মায়ের জন্য ডাবের পানির ব্যবস্হা করতে পারবি পিনু। এত
গরমে বেশি বেশি পানি খাওনের জন্য স্কুলের আপা বলছে।' রুবি এ কথা বলে
পিনুকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলো। আরও বললো, 'আমাদের বিলাইডাও
হাঁসফাঁস করতাছে। মায় বিলাইডারে পানি খাওয়াইতে কইছে।' দুই ভাইবোন
দাওয়ায় বসে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার রূপ দেখতে লাগলো। দূরে আযানের ধ্বনি
ভেসে আসছে। আকাশে গুড়গুড় শব্দ। আকাশের গুড়গুড় শব্দটা ওদের কানে
পৌঁছায় নি। কারণ, রুবি মাথায় মায়ের জন্য একটা ডাব যোগাড়ের চিন্তা আর
পিনু আকাশের রোদগুলোর তেজ বা শক্তি কোন বাক্সে বন্দি করার দিবাস্বপ্নে
বিভোর। একটা কাকের কর্কস কা কা শব্দে আছিয়া বেগম বিছানায় উঠে বসলো।
রুবিকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। 'রুবি তোর ময়না খালা আর বড় দাদুরে একটা
ফোন দিয়া আইতে কওতো মা।' রুবি দৌড় দিয়ে পাশের টিনের ঘরের শেফালী
চাচিকে দিয়ে ময়না খালা আর বড় দাদুরে ফোন করালো। রুবি ঘরে ফিরে দেখলো
আছিয়া বেগম দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে হাঁটার চেষ্টা করছে। প্রচন্ড
ব্যাথায় মায়ের মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে। পিনু কিছু না বুঝেই মাকে নিয়ে
স্বাস্হ্য কেন্দ্রে যাবার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। অন্যদিকে
ময়না খালা আর বড় দাদুর কোনো খবর নাই। রুবি টের পেল পিনু কোথায় যেন চলে
গেছে। মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেই রুবি বলে বসলো, ' মা
তোমার আদরের বিলাইডার খবর জানো? ওর পেটটাও কিন্তু দিন দিন বড় হইতাছে।'
মা দাঁতে কামড় দিয়ে ব্যথা সহ্য করার অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু
বিড়ালের কথা শোনামাত্র বললো, 'বিলাইডার কষ্ট তোরা বুঝবি না। ওরে দেইখ্যা
রাখিস। তোর খালা এহনো আইবার পারলো না। আর সইতে পারতাছি না মা।' এমন সময়
একটা ঠান্ডা বাতাসের ধাক্কায় দরজাটা বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
মুহূর্তেই অন্ধকারে ছেয়ে গেল সব। বাইরে পিন্টুর গলা শোনা যাচ্ছে, 'বুবু
মায়রে নিয়ে শীঘ্রই ভ্যান গাড়িতে উঠো।' এর মধ্যে ময়না খালা আর বড়
দাদু হাজির। সবাই একসাথে ভ্যান গাড়িতে উঠে বসার মাত্র ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি
নামলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সবাই স্বাস্হ্য কেন্দ্রে পৌঁছে গেল। রাতভর
বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ ও আছিয়া বেগমের ব্যথার তাণ্ডব চলতে চলতে খুব সকালে
এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন আছিয়া বেগম। মায়ের ব্যথাহীন শান্ত মুখের
দিকে তাকিয়ে রইল দুই ভাইবোন। নতুন ভাই পাওয়ার আনন্দ তাদের ছুঁয়ে গেল
কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এই মৃম্ময়ী পৃথিবীতে অনেক কষ্টের সঙ্গে ওরা
পরিচিত। এর মধ্যে বন্যা, খরা, ঝড়, বৃষ্টি, নদী ভাঙন ইত্যাদি ওদের জীবনে
নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই রুবির মোবাইল বেজে উঠলো।
মিলুর ফোন। রুবি অবাক হয়ে ফোনটা ধরতেই মিলুর খুশি খুশি গলার আওয়াজ
পাওয়া গেল। ওপাশ থেকে মিলু বললো, 'রানীর পাঁচটা বাচ্চা হইছে। বাচ্চা
গুলা অনেক সুন্দর। এবার কিন্তু আমারে দুইবার বাচ্চা দিতে হইবো। আমার
বিলাই পালার বড় সখ।' রুবি মায়ের বুকের সঙ্গে লেপটে থাকা সদ্য ভুমিষ্ঠ
হওয়া ভাইটিকে দেখল। একই সঙ্গে রুবির চোখের সামনে ভেসে উঠলো পাঁচটি ধবধবে
সাদা বিড়াল ছানা।
চয়নের ভাগ্য ভালো। ঢাকা শহরের একটি ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেল।
চয়ন আজ প্রথম স্কুলে যাবে। বাবা-মা বেশ হাসিখুশি। ছোট বোন নূরী, ক্লাস
ফোরে পড়ে। সেও সারা ঘরে নাচানাচি করছে। চয়নকে প্রশ্ন করেই চলেছে।
স্কুলের ব্যাগটা নতুন। চয়ন ব্যাগটা বারবার নেড়েচেড়ে দেখছে। বেশ
কয়েকটা পকেট আছে। পকেটে কলম পেন্সিল রাখা যাবে। পানি ও টিফিন বক্স
রাখারও ব্যবস্থা আছে।
চয়নের বাবা রাশেদুল ইসলাম স্কুলের গেটে চয়নকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
চয়নের হাতে সময় কম। ট্র্যাফিক জ্যামে অনেকটা সময় চলে গেছে। দোতলার
মাঝামাঝিতে ক্লাস নাইনের বি সেকশন। ক্লাসে ঢুকতেই ছেলেরা হইহুল্লোড় বন্ধ
করে ওকে ঘিরে ধরলো। ওরা ক্লাসের দরজাটা বন্ধ করে দিল। ছেলেগুলোর মধ্যে
একটা গোপন চোখাচোখি চয়নের দৃষ্টি এড়ালো না। ওরা নতুন একজনকে পেয়ে বেশ
উত্তেজিত। কিন্তু কিভাবে চয়নের সাথে আলাপ শুরু করবে সেটা নিয়ে দু এক
মিনিট নিরবে চলে গেল। ওদের মধ্যে একজন বলল, 'ঢাকা শহরে নতুন এসেছো?' ওর
কথার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল। চয়ন উত্তর দিল, 'হ্যাঁ। ঢাকা আগে
আসিনি।' আর একজন বলল, 'তা তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এটা কী? ব্যাগ?
স্কুল ব্যাগ? এই তোরা এদিকে আয়। কেউ মঙ্গল গ্রহের ব্যাগ দেখেছিস? আমাদের
নতুন বন্ধু মঙ্গল গ্রহের ব্যাগ নিয়ে ক্লাসে এসেছে। ব্যাগ নিয়ে ওরা বেশ
কিছুক্ষণ হাসাহাসি করল। এমন সময় ক্লাস টিচারের গলার স্বর শুনে সবাই
দৌড়ে গিয়ে যার যার সিটে বসে পড়ল। চয়ন হাফ ছেড়ে বাঁচলো! কিন্তু অংক
টিচারের পরিবর্তে ক্লাসে এলেন অন্য একজন টিচার। চয়নের সবচেয়ে প্রিয়
সাবজেক্ট অংক । প্রথম ক্লাসে ঢুকেই ওর ব্যাগ নিয়ে ছেলেদের বিদ্রুপাত্মক
মন্তব্য এবং এখন আবার অংকের পরিবর্তে অন্য টিচারের আগমন। চয়নের মন
কিছুটা খারাপ হয়ে গেল । কিন্তু চয়নের মন খারাপ স্থায়ী হলো না।
টিচার ক্লাসে এসে খুব শান্ত দৃষ্টিতে সবাইকে এক নজর দেখে চেয়ারে বসলেন।
তিনি বললেন, 'তোমরা সবাই কেমন আছো? বছরের চার মাস সময় কেটে গেছে।
নিশ্চয়ই তোমরা পড়াশোনায় দিন দিন ব্যস্ত হয়ে উঠছো।' ক্লাসের কেউ কেউ
অস্ফুট কন্ঠে বলল, 'জ্বী ম্যাম।' 'আজ তোমাদের অংক টিচার হঠাৎ একটি
গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই এ ক্লাসটা তোমাদের সাথে আমি
থাকবো।' আমার নাম অরুন্ধতী রায়। চয়ন দেখলো ম্যামের হাতে একটি মোটাসোটা
বই। বইয়ের নামটি চয়ন দূর থেকে পড়তে পারছে না। বইটি ম্যাম টেবিলের
উপরে রাখলেন। নতুন এই ম্যাম কোন্ বিষয়ে পড়াবেন তা জানতে ক্লাসের সবার
কৌতুহলী চোখ অপেক্ষা করছে। কিন্তু ম্যামকে দেখে মনে হলো তার কোন
তাড়াহুড়া নেই। তিনি এসেছেন সারাদিনটি এ ক্লাসের সবার সঙ্গে গল্প করে
কাটাবেন বলে। তিনি গল্প শুরু করে বললেন, আমি তোমাদের অংক নয়। বরং অন্য
একটি বিষয় নিয়ে গল্প করব। ক্লাসের সবাই তো একটু অবাক। ম্যাম গল্প
করবেন? এ ধরনের প্রস্তাব ম্যামদের কাছ থেকে ছাত্ররা কখনোই শোনেনি।
ম্যামেরাই ক্লাসে বেশি কঠোর। ম্যামদের ক্লাসে ওরা বেশি মনোযোগী থাকে। তাই
নড়েচড়ে ম্যামের মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে ছাত্ররা। চয়ন খেয়াল
করলো ম্যাম দেখতেও বেশ হাসিখুশি। ক্লাসের তুখোর ছেলে সিফাত বলল, 'আমরা আজ
কিসের গল্প শুনবো ম্যাম? ম্যাম বললেন, 'তোমাদের শোনাবো অসুস্থ মাছের
গল্প।' ক্লাসের ছেলেদের চোখ ছানাবড়া। মাছ ? তাও আবার অসুস্থ মাছ! সবাই
তো হরেক রকম মাছ বাজার থেকে কিনে এনে মজা করে রান্না করে খায়। মাছের
অসুস্থতার কথা তো কেউ কোনদিন শোনেনি। 'কী মাছ ম্যাম?' এবারের প্রশ্ন এলো
নির্ঝরের কাছ থেকে। বাংলাদেশের নদ-নদীতে মজার স্বাদের অনেক মাছ পাওয়া
যায়। 'তোমাদের প্রিয় মাছ কি?'
মনির বলল, 'ইলিশ আমার প্রিয় মাছ। আমাদের জাতীয় মাছ।' ছাত্ররা একে একে
তাদের প্রিয় মাছের নামগুলি বলতে লাগলো। ওদের মধ্যে অনেক উদ্দীপনা লক্ষ্য
করলেন ম্যাম। 'এই মাছগুলোর বাড়ি কোথায় জানো?' ম্যামের আবার এক অদ্ভুত
প্রশ্ন! মাছের আবার বাড়ি থাকে নাকি! বাদশা নামের ছাত্রটি এবার বলে উঠলো,
'ম্যাম আমি মাছ খেতে পছন্দ করি না। তাই আমি ওদের বাড়িঘরের ঠিকানা
জানিনা। মুরগির মাংস আমার ফেভারিট। আর মুরগির বাড়ি হল ডেইরি ফার্ম।' ওর
কথা শুনে সবাই হাসিতে ফেটে পড়লো। সাথে ম্যামও হাসছেন। চয়ন খুব মজা পেল।
তার আগের স্কুলের ক্লাসগুলো খুব একঘেঁয়ে ছিল। চয়ন এবার সাহস করে বলল,
'মাছের বাড়িঘর হলো সাগর, নদীনালা, খালবিল ও হাওর ইত্যাদিতে।' সবার চোখ
চয়নের দিকে। ক্লাস বেশ জমে উঠেছে। ম্যাম বললেন, পুকুরেও কিন্তু মাছ
পাওয়া যায়। তোমার নাম কি?' 'চয়ন' ঝটপট উত্তর দিল। তোমার মাছের বাড়ি
কোন্ নদীতে? ম্যাম জানতে চাইলেন। 'তেঁতুলিয়া নদীতে' চয়নের জবাব। বাহ্!
'তুমি তো বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ছেলে। তোমার বাড়ি কোথায়?' 'ভোলা'।
'ম্যাম, আপনার অসুস্থ মাছের নাম কি আর সে মাছ কোন নদীতে থাকে?' এবারের
প্রশ্ন করলো অরুন। ম্যাম বললো, 'সে এক বড় ইতিহাস। তোমরা নিশ্চয়ই জানো
পানির নীচে এক বিশাল জগতে আছে। সে জগতে রয়েছে অনেক নাম না গাছপালা ও
প্রাণি। আরও রয়েছে জালের মতো বয়ে যাওয়া নদ নদীতে মিঠে পানির বিভিন্ন
ধরনের সুস্বাদু মাছ। তোমরা জানতে চেয়েছো অসুস্থ মাছের নাম কি? অসুস্থ
মাছের নাম বলার আগে তোমাদের আরো কিছু জানতে হবে। দক্ষিণে বিশাল
বঙ্গোপসাগরের লোনা পানির মাছ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব নদীনালা, খাল,
বিল, ডোবা বা হাওরের মিঠে পানির মাছ আমাদের সম্পদ। ছোটবেলায় খারোই (এক
ধরনের বাঁশ বা বেতের তৈরি ব্যাগ। গ্রাম্য ও শহর অঞ্চলে ব্যাগে বাজার করা
হতো) নিয়ে বাবা চাচারা বাজার থেকে মাছ কিনে আনতো। মা চাচীরা রান্না
করতো। আর আমরা মজা করে গরম গরম মাছভাত খেতাম। এ কারণেই আমরা 'মাছেভাতে'
বাঙালি বলে পরিচিত ছিলাম। 'ম্যাম, আমরা এখনো তো গরম গরম মাছ ভাত খাই।'
তাহলে সমস্যা কোথায়? প্রশ্ন করলো কবির। 'সমস্যা আছে। নানা প্রজাতির মাছ
এখন হারিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় আমরা যেসব মাছ খেয়েছি তোমরা অনেকে সেইসব
মাছের নামও শোননি। সেসব সুন্দর সুন্দর রঙিন মাছগুলো কোথায় হারিয়ে গেল!'
'সেসব মাছের নাম কি ম্যাম?' পিছনের বেঞ্চ থেকে পলাশের প্রশ্নে ম্যাম
বললেন, 'যেমন ধরো খলিসা, দারকিনা, ফলি, বাচা, কাজলি, বৈরালী, মেনি,
বাঘইর, গুতুম ইত্যাদি মাছ। এসব মাছ পুষ্টিগুণে ভরপুর। ছোট-বড় অনেক মাছের
আজ আর দেখাই মেলে না। এখন আমরা শুধু চাষের মাছ খাই।' বাজারে গেলে আমরা
বড়ছোট চাষের মাছ কিনে বাড়ি ফিরি।' 'এসব মাছ কোথায় গেল?' রুবেল জানতে
চাইল। এসব মাছ হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে জলবায়ুর
পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করা, নদী-নালা খাল
বিল ভরাট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
কিন্তু আমি আজ মাছ কি কারণে অসুস্থ হচ্ছে এবং সেই অসুস্থ মাছ খেয়ে মানুষ
কিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে তা নিয়ে তোমাদের সচেতন করার চেষ্টা করবো।
অর্থাৎ মানুষের কর্মকাণ্ডই এখন মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এতক্ষণে অসুস্থ মাছের গল্পে আসলেন নতুন টিচার। সবাই গল্প শোনার জন্য বেশ
আগ্রহ নিয়ে বসে আছে।
ম্যাম বললেন, প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন কাজে পলিথিন ব্যবহার করি। এই যেমন
ধরো, বাজার থেকে আমরা যা-ই কিনি না কেন, তা বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসার
জন্য আমরা পলিথিন ব্যবহার করি। শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ মাংস ছাড়াও তোমরা
আজকাল যেসব নামীদামী রেস্তোরাঁ থেকে খাবার কিনে খাও, সেসব খাবারগুলো
প্লাস্টিক জাতীয় জিনিস দিয়ে প্যাকেট করা হয়। কোমল পানীয় কিংবা
বোতলজাত জুস পানি এগুলো সবই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি বোতলে বিক্রি করা হয়।
এগুলোর নাম আমি দিয়েছি জঞ্জাল। 'জি ম্যাম, আমি শুনেছি প্লাস্টিকের
ব্যবহার পরিবেশের জন্য খুব খারাপ।'এমনকি মাঝে মাঝে রেডিও টেলিভিশনেও এ
সম্পর্কে অনেক আলোচনা শোনা যায়।' একথা বললো সিফাত। 'কিন্তু ম্যাম
এগুলোকে আপনি কেন জঞ্জাল বলছেন?' মনিরের এই প্রশ্নে ম্যাম জবাব দিলেন,
ব্যবহারের পর এগুলো আমরা রাস্তাঘাটে অথবা নদী-নালা বা এর আশেপাশে ফেলে
দেই। শেষ পর্যন্ত এই জঞ্জালগুলো গিয়ে নদী নালা অথবা সমুদ্রে ঠাঁই পায়।
লঞ্চ বা অন্য যেকোনো নৌযানে ভ্রমণের সময় তোমরা চিপস বা চকলেটের খোসা,
কোকাকোলার ক্যান কিংবা পানির প্লাস্টিকের বোতল নির্দ্বিধায় নদীতে ছুঁড়ে
ফেলো। তোমরা প্রত্যেকেই ভাবো, আমি মাত্র একটি প্লাস্টিক বোতল নদীতে
ফেলেছি। এত বড় নদীতে এটা সামান্য আবর্জনা। কিন্তু ভেবে দেখো! সবাই যদি
এভাবে প্লাস্টিক বা পলিথিন নদী বা সমুদ্রে প্রতিনিয়ত ফেলতে থাকে, তাহলে
একসময় পানির নিচে পলিথিনের পাহাড় তৈরি হবে। তোমরা শুনলে অবাক হবে এভাবে
প্রতিবছর ৮ লাখ টন প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। মাছের
অসুস্থতার সঙ্গে পলিথিনের কি সম্পর্ক ম্যাম? নীরব এবার সরব হয়ে এ
প্রশ্নটি করে বসলো। 'এখানেই তো এই গল্পের ট্রাজেডি।' বললেন ম্যাম।
এই পলিথিনগুলো সমুদ্রে ভাসতে থাকে। এইসব জঞ্জাল পচনশীল নয়। তাই এদের কোন
মৃত্যু নেই। শুধু এগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ছোট ছোট কণায় রূপ নেয়।
এই ছোট ছোট কণাগুলোকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক
গুলোকে মাছ প্রজাতি খাবার মনে করে খেয়ে ফেলে। অথবা পানির সাথে মাছের
পাকস্থলীতে গিয়ে জমা হয়। তোমরা শুনলে আশ্চর্য হবে থাইল্যান্ডে একটি মৃত
তিমি মাছের পেটে ৮০টি প্লাস্টিকের ব্যাগ পাওয়া গেছে। হজম করতে না পারায়
তিমি মাছটি মরেই গেল।
এবার চয়ন মুখ খুলল। তার প্রশ্ন হলো, 'ম্যাম পলিথিনে কোন স্বাদ নেই। মাছ
কেন পলিথিন খেতে যাবে? 'খুবই বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করেছে চয়ন।' বললেন
ম্যাম। আসলে বিষয়টি স্বাদের নয়। মাছ প্লাস্টিক বা পলিথিন কখনো কখনো
খাবার ভেবে খেয়ে ফেলে। অথবা পানির সাথে আপনা আপনি এগুলো মাছের
পাকস্থলীতে চলে যাচ্ছে। পরীক্ষায় মাছের মুখে, পেটে, ডিমে ছোট ছোট
প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের নদ নদীর মাছও এ থেকে
বাদ পড়েনি। প্লাস্টিকের কারণে মাছগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পেটের মধ্যে
প্লাস্টিকের বর্জ্য নিয়ে কত কষ্টে মাছদের দিন কাটছে তোমরা চিন্তা করে
দেখো। কিন্তু সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো মানুষ এর জন্য দায়ী।
মানুষ যদি প্লাস্টিকের ব্যবহার না করত কিংবা সমুদ্র বা নদীতে প্লাস্টিক
ফেলে না দিত তাহলে মাছের এই দুর্দশা হতো না। আবার এই প্লাস্টিক মাছ বাজার
থেকে কিনে এনে আমরা খাচ্ছি। আমরা জানতেও পারি না এসব প্লাস্টিক মাছ
আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা খারাপ। এই প্লাস্টিক মাছ খেলে কিডনি,
থাইরয়েড, এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশের নদীগুলোতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের
প্রিয় মাছগুলো প্লাস্টিক মাছ হয়ে যাচ্ছে। এ প্লাস্টিক মাছগুলোকেই আমি
বলি অসুস্থ মাছ। এই অসুস্থ মাছ খেয়ে আমরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছি।' 'এ থেকে
বাঁচার উপায় কি ম্যাম?' ক্লাসের অনেক ছাত্ররাই একসাথে প্রশ্নটি করে
বসলো।
'প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা। যত দ্রুত সম্ভব। প্লাস্টিকের পরিবর্তে
এমন জিনিস ব্যবহার করতে হবে যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। যা আমাদের
প্রিয় মাছগুলোকে অসুস্থ করবে না। 'সেটা কি করে সম্ভব ম্যাম? ড্রিঙ্ক
কিংবা রেস্তোরাঁ থেকে যেসব খাবারে আমরা পলিথিন ব্যবহার করি, সে পলিথিন এর
বিকল্প তো কিছুই নেই অথবা বাজারে অগণিত পলিথিনের ব্যবহার কেমন করে বন্ধ
করা সম্ভব? পলিথিন আমাদের জীবনকে অনেক আরামদায়ক করেছে। আমরা কি করে
পলিথিন ছাড়া একদিনও বেঁচে থাকতে পারি? সবার একই প্রশ্ন। 'এ প্রশ্নের
উত্তর তোমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে যদি এই প্লাস্টিক মাছের পরিবর্তে সেই
স্বাদের মাছগুলো খেতে চাও।
তবে আজকের ক্লাসে আমি একজনকে দেখতে পাচ্ছি যার কাছে সমাধানের মত একটি
জিনিস রয়েছে। ক্লাসের সবার মধ্যে একটি কৌতুকের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবাই
বেশ মজা পাচ্ছে। এদিকে ক্লাসের সময়ও ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ খুঁজে
পাচ্ছে না কি জিনিস এবং কার কাছে সেটা আছে ---এ প্রশ্নের উত্তর। ম্যাম
উঠে দাঁড়ালেন এবং চয়নের বেঞ্চের কাছে এসে তার স্কুল ব্যাগটা দুই হাতে
উঁচু করে সবার সামনে তুলে ধরে বললেন, 'এই হলো সেই জিনিস, যা আমাদের
অসুস্থ মাছকে সুস্থ করতে পারে, আমাদের পরিবেশকে নির্মল রাখতে পারে এবং
মানুষকে সুস্থ করে এ পৃথিবীকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য করে তুলতে পারে।
ব্যাগের উপর দুটি সবুজ পাতার ছবি আঁকা। ম্যাম বললেন, এটি হলো পাটের তৈরি
ব্যাগ। প্লাস্টিকের পরিবর্তে আমাদের ব্যবহার করতে হবে পাটের জিনিস যা
পরিবেশবান্ধব এবং সহজেই পচে মাটিতে মিশে যেতে পারে। মানুষের সুস্থতার
জন্য এবং দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য পাট ও কাগজের ব্যবহারে ফিরে যেতে হবে
আমাদের। এমন সময় ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজে উঠলো। চয়নের ব্যাগটা দেখার জন্য
সবাই চয়নকে ঘিরে দাঁড়ালো। পাট এবং পাটের ব্যাগ সম্পর্কে ছেলেদের
প্রশ্নের শেষ নেই। চয়ন ভাবছে ক্লাসে ঢোকার মুহূর্তে এই ব্যাগটা নিয়ে
তাকে কতই না নাজেহাল হতে হয়েছে! আর এখন ঠিক তার উল্টো দৃশ্য। ম্যাম
ছেলেদের পাটের ব্যাগে আগ্রহ তৈরি করে ক্লাস রুম থেকে বিদায় নিলেন।
একটা ছোট ছেলে। বয়স বার তেরো হবে। গলি ঘুপচিতে বাস করে। মা বাপ কিছু
নেই। ছোট ছেলেটার পেটে ভাত পানি নেই। সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে আর
ঘোরে। রাত হলে ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়ে। ছেলেটার একটা নাম আছে। ওর নাম মিলন।
কি সুন্দর নাম। ঠিকানাহীন মিলন একদিন ভাবলো এই গলি ঘুপচিতে না থেকে
জঙ্গলে বসবাস করলে কেমন হয়? কিন্তু জঙ্গলের ঠিকানা মিলন জানে না। তাই
একদিন গলি ঘুপচি থেকে বেরিয়ে পরল সে। সোজা হাঁটা শুরু করল। হাঁটার পথ
শেষ হয় না। সে জানে তাকে কেউ খুঁজবে না। কোন আপনজন নেই তাই। বিশ্রামের
জন্য একটু দাঁড়াল। পিছনে দেখল একটা সাদা কাক। মিলন অবাক হয়ে সাদা কাকের
দিকে তাকিয়ে রইল। মিলন ভাবল সাদা কাকটারও কেউ নেই। তাই ও আমার সাথী
হয়েছে। কাকটা কখনো মিলনের মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে। আবার কখনো পিছনে
পিছনে হাঁটার চেষ্টা করে। একটু ভয় ভয় চোখে বারবার মিলনকে দেখে। মিলনের
নিজেরই খাবার নেই। তাই সাদা কাকটাকে কিছু খেতে দেওয়ার উপায়ও নেই। যাক,
দুজনেই হাঁটতে থাকে। মিলনের মনে হতে থাকে সাদা কাকটা তাকে জঙ্গলের পথ
দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বেশ ভালোই হলো। এভাবে সাত দিন হাঁটা শেষে এক গভীর
রাতে তারা একটা জঙ্গলের সামনে এসে পৌঁছে। একটা উত্তেজনা মিলনকে আচ্ছন্ন
করে ফেলে।
আশ্চর্য এখানটা এত শান্ত, এত স্নিগ্ধ, বাতাস এত নির্মল! মায়াময় পরিবেশ।
মনে হয় যেন এতদিন পর সে তার আপন ঘরে ফিরেছে। সাথে কাকটা থাকায় একা একা
ভাবটা দূর হয়ে গেছে। বনের ভিতর একটা গাছের নিচে দুজনে বসে।আশেপাশে অনেক
নাম-না-জানা গাছ। সেসব গাছে অনেক ফল। গাছের ডালে বসে ফলগুলো ঠোকর দিচ্ছে
কাকটা। নিচে দুই একটা ফল পড়ছে। সেখান থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে মিলন ফল
খাওয়া শুরু করলো। রসালো ফল। স্বাদও বেশ। খালি পেটে যা পড়বে সবই অমৃত।
কাক এবং তার জঙ্গলে বসবাস শুরু হলো। মিলন সাদা কাকের নাম দিল লেয়া।
দুদিন কেটে গেল।
একদিন রাতে মিলন লক্ষ্য করল জঙ্গলের অনেক গভীরে একটি টিম টিমে আলো
জ্বলছে। ওর মনে হলো ওখানে কোন মানুষের বসবাস আছে। কিন্তু মানুষের কাছে
ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছা মিলনের নেই। তাই দূর থেকে মিলন শুধু আলোর দিক
তাকিয়ে রইল। এই গভীর জঙ্গলে মিলনের একমাত্র সঙ্গী লেয়া। লেয়াকে নিয়েই
ওর জঙ্গলের জীবন শুরু। লেয়ার দিকে তাকালো মিলন। লেয়া নেই। আশেপাশে
কোথাও লেয়া নেই। মিলন হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে গেল। তাহলে লেয়াকে কি কোন
হিংস্র জীবজন্তু খেয়ে ফেলেছে? মিলন কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এখন
রাত। গাছের ডালে বসে বসে মিলন দূরের টিমটিমে আলোর দিকে আবার দৃষ্টি দিল।
আলোটা আগের চেয়ে উজ্জ্বল লাগছে। কী ব্যাপার! আলোটা নড়াচড়া করছে। আরও
উজ্জ্বল, আরও উজ্জ্বল। ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল হচ্ছে আলোর শিখাটি। মিলনের
একটু একটু ভয় লাগছে। কিন্তু ভয়ের চেয়েও কৌতুহল বেশি হচ্ছে। মিলন মনে
মনে সাহস সঞ্চার করতে লাগল। কিন্তু গাছের ডালের আশ্রয় থেকে নীচে না নেমে
অপেক্ষা করাই মিলনের কাছে নিরাপদ মনে হলো। হঠাৎ মিলন অনুভব করল তার শরীরে
অন্য রকম একটা অনুভূতি। শিরদাঁড়া বেয়ে কিছু নীচের দিকে নামছে। শরীরটা
মোচড় দিলো মিলন। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। লেয়া নেই কেন? চারিদিকের
অন্ধকারের মধ্যেও সাদা রঙের কারণে লেয়াকে স্পষ্ট দেখা যেত। তাহলে এ আলোর
পিছনে কী লেয়ার কোনো হাত আছে। লেয়া আসলে কাক না অন্য কিছু! ভয়ে মিলনের
অবস্হা খারাপ। জ্বীন, ভূত পেত্নীর গল্প নানুর কাছ থেকে শুনেছে। তখন খুব
একটা ভয় পায়নি মিলন। নানু মারা গেছে তাও আজ বছর তিনেক হলো। সাদা কাক
লেয়া কি কোন জ্বীন ভূত? লেয়াই তো আমাকে মোহমুগ্ধের মতো এ জঙ্গলের পথ
দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। নইলে ঐ গলি ঘুপচিতে আমিতো ভালই ছিলাম। নিজের সাথে
নিজে কথা বলতে শুরু করল মিলন। নাহ্ ভয় পেলে চলবে না। ভালো করে দেখতে হবে
বিষয়টি কী। একটা সাদা অবয়ব এগিয়ে আসছে। অনেক দূর থেকে। কখনো অবয়বটা
মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার সাথে সাথেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেশ লম্বা। ঘোড়ার
কেশরের মত বাতাসে কিছু একটা ভেসে আসতে আসতে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা
মিষ্টি গন্ধ চারদিকে। এবার আরও সামনে এগিয়ে আসছে। গাছের ডাল পাতার
আড়ালে মিলন নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চেষ্টা করলো। লম্বা একটা মানুষ। রেশমি
সাদা পোশাকে আবৃত। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। মিলন বিরক্ত হলো। মানুষের কাছ
থেকে পালিয়ে জঙ্গলে ঠাঁই নিলাম, সেখানেও মানুষের হাত থেকে মুক্তি নেই।
লেয়ার উপরে মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছে মিলনের। এই দুঃসময় লেয়া কাছে থাকলে
একটু সাহস পেত। অন্তত কাকা শব্দে একটু ভয় ধরিয়ে দিলে সামনে এগিয়ে আসা
এই সাদা আপদটা পালিয়ে যেত। সাদা বস্তূটার মুখের দিকে তাকালো মিলন। খুব
সাহস করে। কিন্তু মুখটা কাকের মত। মুখটা লেয়ার মতো লাগছে। ঘাড়ের ধবধবে
সাদা কেশরগুলো অপূর্ব সুন্দর। বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে এ
যেন এক অদ্ভুত সুন্দর জঙ্গল। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সবকিছু বেশ পরিষ্কার
দেখা যাচ্ছে। লেয়ার লম্বা ঠোঁটটা কোথায়? সূচালো ঠোঁট দিয়ে গাছ থেকে ফল
ঠোকরানোর দৃশ্যটা মিলনের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। চোখ কচলে মিলন দেখার
চেষ্টা করছে। ঠোঁটের দুই সূচালো অংশ মধ্যখানে মিশে গেছে এবং ঠোঁটের
দুপাশের চওড়া অংশ পাতলা গালের সাথে সুন্দরভাবে বসে গেছে। সম্পূর্ণ
গোলাপী রংয়ের ঠোঁট। চোখগুলো কালো। ঠিক মার্বেলের মতো। লেয়ার এ রূপ দেখে
মিলন হতভম্ব হয়ে গেল। প্রচন্ড ভয়ে মিলন গাছ থেকে পড়েই গেল। কিন্তু
শরীর মাটিতে স্পর্শ করার আগেই ওর হালকা দেহটা যেন শূন্যে ভেসে উঠলো। মিলন
আর্তনাদ করলো। কিন্তু গলা থেকে কোনো স্বর বের হলো না। ভয়ার্ত চোখে মিলন
দেখতে চেষ্টা করল সে কোথায় আছে। শূন্যে ভেসে আছে নাকি কারো হাতের ডগায়
ঝুলে আছে। পরক্ষণেই লেয়ার হাতের কব্জিতে মিলন নিজেকে আবিষ্কার করলো।
হাতের পিছনে দুই বিশাল পাখা। এমন সুন্দর জীব মিলন আগে কখনো কল্পনাও
করেনি। মিলন জানতে চাইল, ' তুমি কী আমার বন্ধু লেয়া? একটা শব্দ হলো।
তারপর কেউ যেন অদ্ভুত কিছু শব্দ করলো। মিলন কিছুই বুঝতে পারলো না। এরপর
মিলনের অবাক হবার আরও কত যে ঘটনা ঘটতে থাকলো তার কোন হিসেব নেই।
এক সাথে হাজারখানেক প্রশ্ন মিলনের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। সাদা কাক
সেজে লেয়া আমাকে জঙ্গলে নিয়ে এলো কেন, আসলে লেয়া আমার বন্ধু না শত্রু,
ওর আসল উদ্দেশ্য কি। লেয়া কী পৃথিবীর জীব? নানুর সেই ভূতের গল্পের ভূত
না পেত্নি? ভাষা জানা থাকলে নতুন রূপধারী লেয়ার আসল উদ্দেশ্য জানা যাবে।
লেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মিলন এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। হঠাৎ
মিলন একটা গানের সুর শুনতে পেল। ওর অনেক প্রিয় একটা গানের সুর। মায়ের
পেটে ভিতরে থাকার সময় থেকে এ গানটা ওর পরিচিত। লেয়ার মার্বেল মার্কা
চোখের দিকে তাকিয়ে মিলন একটা স্নেহের দৃষ্টি দেখতে পেল। এতক্ষণ পরে
লেয়ার শুদ্ধ বাংলায় গভীর কন্ঠে বলল,' 'ভয় পেয়ো না মিলন। 'আমি তোমার
বন্ধু লেয়া। আমাকে তুমি বাবা বলেও ডাকতে পারো।' 'লেয়া তুমি কে? আমাকে
এখানে নিয়ে এলে কেন?' তুমি আমাকে বাবা বলে ডাকতে বলছো কেন? কাক কখনো
মানুষের বাবা হয়?' 'হবে না কেন?' তুমি যদি আমার পৃথিবীর মানুষ হতে তাহলে
তুমি কিন্তু আমাকে বাবা বলেই ডাকতে। 'আমি কাকের মতো মানুষকে কখনোই বাবা
বলে ডাকতাম না। তাছাড়া আমি তো আমার বাবাকে দেখিনি। আমার পৃথিবীতে আসার
আগেই তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।' মিলন সাফ সাফ জানিয়ে দিল তার কথা।
'তুমি আমার কাছে শুধুই লেয়া, মানে কাক বন্ধু, বুঝেছো?' মিলন বেশ শক্ত
হয়ে কথাগুলো বলল।
লেয়া মাটিতে বসে পড়ল। মুখটা একটু ম্লান। কিন্তু মিলন লক্ষ্য করল লেয়া
অনেক জায়গা দখল করে বসেছে। চারদিকে নরম রেশমের মত কেশরগুলো বিছিয়ে
পড়েছে। গোলাপী ঠোঁটের ফাঁকে দাঁতগুলো দেখে মিলন আরও অবাক হয়ে গেল।
'আচ্ছা লেয়া তুমি বাংলা ভাষা শিখলে কখন?' মিলনের সরাসরি প্রশ্ন। লেয়া
বলল, 'আমিতো তোমাদের পৃথিবীর সব ভাষায় কথা বলতে পারি। শুধু ল্যাবে সুইচ
টিপে বাংলা লিখে দিলেই বাংলা কথা বলা সম্ভব।' মিলন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল
লেয়ার দিকে। ইংরেজি কার্টুন ছবিগুলো ভাষার জন্য মিলন বুঝতে পারতো না।
তাও আবার অন্যের টিভি যা দশ হাত দূর থেকে দেখার কসরৎ করতে হতো। আর লেয়া,
সামান্য একটা কাক! সে কিনা পৃথিবীর সব ভাষা জানে।
রহস্যময়। রহস্যটা কী? মিলন চুপচাপ ভাবতে বসে। লেয়া তাকে নরম রেশমী
শরীরের পাশে গভীর মমতায় টেনে নেয়। অনেকদিন পরে যেন একটি স্নেহের স্পর্শ
পেল মিলন। মিলন চুপচাপ বসে থাকার ছেলে নয়। তার কৌতুহল বেড়েই চলেছে।
বিশেষ করে যখন দেখলো লেয়া মানুষের রূপে বন্ধুর মতো আচরণ করছে। আবার তাকে
বাবা বলে ডাকার আব্দার ধরেছে। তাহলে ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা খতিয়ে
দেখতে হবে বৈকি। 'তুমি কোথায় থাকো? কী খাও? তোমার বাড়িতে আর কে কে
থাকে? ' একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন মিলন ছুঁড়ে দিল লেয়ার দিকে। লেয়া সাথে
সাথে জবাব দিল। 'আমি তো তোমাদের পৃথিবীতে থাকি। তবে মাত্র কিছুদিনের জন্য
এখানে এসেছি। আমাকে কিছু খেতে হয় না। আমার সাথে আরো এক ডজন লেয়া আছে।
তারা সবাই দূরে ঐ টিমটিম করা আলোর পাশে বসে আছে। ওরা আমার ফিরে যাবার
অপেক্ষা করছে। আমি বেশিদিন তোমাদের পৃথিবীতে থাকবো না। অন্য লেয়ারা ফিরে
যেতে অস্থির হয়ে গেছে। তবে আমার মিশন এখনো শেষ হয়নি। 'কী মিশন তোমার?
কোথায় ফিরে যাবার কথা বলছো?' মিলনের প্রশ্ন। লেয়া বলল, 'দেখো দিনের আলো
ফুটেছে। আজ আর নয়। আমাকে এখনই ফিরতে হবে। আবার কথা হবে আগামীকাল রাতে।'
হঠাৎ সবকিছু মিলিয়ে গেল। যেন মিলন স্বপ্ন দেখছিল। নিজের গায়ে চিমটি
কেটে দেখল যে সে স্বপ্নে বিভোর নেই। গাছের ডালে পাখিরা ডাকছে। সূর্যের
আলোতে লম্বা লম্বা গাছগুলোর মাথা থেকে ছিটকে আসা কাঁচা সোনা রোদে জঙ্গলটা
আলোকিত। মনে হলো জঙ্গলটা যেন হাসছে। কী অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। মিষ্টি
গন্ধটা মিলিয়ে গেছে। মাটির ঘ্রাণে মিলন তার বাস্তব অবস্থা টের পেল। আহ্
কি একটা সময় কেটে গেল। মনে হয় ক্ষুধা তৃষ্ণা মরে গেছে। শুধু ঘুমে দুই
চোখ ভারী হয়ে আসছে। লেয়া তো নেই! রাতের কথা ভাবতে ভাবতে মিলন ঘুমিয়ে
গেল।
সারাদিন ঘুমিয়ে রাতে মিলনের ঘুম ভাঙল। চারপাশে তেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার
নেই। বরং লম্বা লম্বা গাছগুলো জোসনার আলোতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। মিলনের
পানির পিপাসা লেগেছে। ধারেকাছে কোথাও ঝর্না বা নদী থাকতে পারে। বন্য ডাব
নারিকেল দিয়ে দুদিন কেটে গেছে। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। মিলনের এখন আর
রাতে ভয় লাগে না। সে গাছের ডাল থেকে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে। চারিদিকে
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। রাত হলেও সব কিছু
পরিষ্কার দেখতে পায় মিলন। অনেক দূর হাঁটার পরে একটি ছোট খাল চোখে পড়ে
মিলনের। খালের পানিতে পা রাখার জন্য সামনে যেতেই কাদামাটির মধ্যে পড়ে
গেল মিলন। মনে হলো কাদা মাটির ভিতর থেকে কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওকে
অতল গহীনে। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দিতে লাগলো মিলন। চোরাবালি ওকে
মৃত্যুর মুখে নিয়ে যাচ্ছে। বাঁচার কোন উপায় নেই। ও শুধু লেয়া লেয়া
বাবা বাবা বলে চিৎকার করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন
লেয়ার নরম শরীরের মধ্যে নিজেকে ডুবে থাকতে দেখলো। নরম কাদা মাটির
পরিবর্তে সাদা রেশমি ঘন পশমের চাদরের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেয়ে মিলন
আনন্দে কেঁদে ফেলল। লেয়ার মার্বেল চোখেও বিন্দু বিন্দু পানি। ঠিক পানি
না, যেন মুক্তার মত শিশির কণা।
লেয়া বলল, 'তুমি কত দিন এ জঙ্গলে থাকবে? এখানে অনেক বিপদ। হিংস্র
জীবজন্তু, সাপ, আকাশে উড়ে বেড়ানো শকুন চিল ইত্যাদি তোমাকে যেকোনো সময়
ছিঁড়ে ফেলতে পারে। তোমার কিন্তু শহরে ফিরে যাওয়া উচিত।' মিলন বলল,
'তুমিই তো পথ দেখিয়ে আমাকে জঙ্গলে নিয়ে এসেছ! কেন এনেছো?' তোমার মিশন
কি?' লেয়া সাথে সাথে উত্তর দিল, 'আমার ইচ্ছা আমাদের পৃথিবীতে তোমাকে
নিয়ে যাই। সেখানে তোমার মতো আরেকটি মিলন আছে। সে তোমার অপেক্ষায় দিন
গুনছে।' মিলন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লেয়ার মুখের দিকে। 'তোমাকে নিতেই
আমি এ পৃথিবীতে এসেছি।' একথা বলেই লেয়া অদৃশ্য হয়ে গেল। মিলনের ভীষণ
রাগ হলো। কথা শেষ না করে লেয়া চলে গেল! মিলন এতক্ষণে খেয়াল করল প্রায়
সকাল হয়ে গেছে। সকালের আলো ফোটার আগেই লেয়া চলে যায়। মিলন নিজের রাগ
সামলে নিল। মিলন যতক্ষণ লেয়ার কাছে থাকে ততক্ষণ কোন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা
মিলনকে আক্রমণ করতে পারেনা। লেয়া চলে যাওয়ার সাথে সাথে দুচোখ ভেঙে শুধু
ঘুম আসে। মিলন গাছের উপরে তার ঘুমের জায়গাটিতে উঠে গেল এবং সাথে সাথে
ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল। সেদিনের মতো সারাদিন ঘুমিয়ে পার করে দিল।
রাতের অন্ধকারে মিলনের ঘুম ভাঙ্গে। মিলন গাছের বিছানা ছেড়ে নীচে নেমে
মাটিতে পা রেখে চমকে গেল। নরম পিচ্ছিল কিছু একটা পায়ের নীচে নড়ে উঠলো।
মিলন সাথে সাথে পা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু যেদিকেই পা ফেলে
সেদিকেই একই অবস্থা। ফোঁস ফোঁস শব্দে মিলনের বুঝতে দেরি হলো না এটা একটা
বিশাল আকৃতির অজগর সাপ। মিলনের মতো গাছটা এই সাপটির বাসা বাড়ি। সাপটি
খাবার সন্ধানে এ কয়দিন কোথাও গিয়ে এখন ফিরে এসেছে। একথা চিন্তা করার
আগেই মিলন অনুভব করল তার শরীর কেউ কঠিনভাবে পেঁচিয়ে ধরছে। এবার তাকে কে
রক্ষা করবে? কিন্তু মিলনের অজান্তেই গলা থেকে লেয়া লেয়া বাবা বাবা ডাক
বেরিয়ে আসছে। তারপর? আর কিছুই মনে নেই মিলনের। যখন মিলন চোখ খোলে তখন
দেখতে পায় দূরে বিশাল আকৃতির একটি সাপ মরে পড়ে আছে। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ
মিলনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে ঘ্রাণের উৎস খুঁজতে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে।
মিলন উপরে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখে লেয়া তার বিশাল পাখা চারিদিকে
প্রসারিত করে তাকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। মিলন লেয়া লেয়া বলে ডাকতে
থাকে। কিন্তু লেয়া মিলনের ডাক শোনে না। সে আকাশে উড়তে থাকে। মিলন উপায়
না দেখে ওর পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত দুজনে জঙ্গলের এক
বিশাল প্রাঙ্গণে পৌঁছে যায়। একেবারে ফাঁকা শূন্য প্রান্তর। প্রান্তরের
মাঝখানে লেয়া তার পাখা পুরোপুরি বিস্তার করে বসে পড়ে। মিলন কিছুটা পরে
লেয়ার কাছাকাছি পৌঁছে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে। লেয়ার চারপাশে অনেকগুলো
ছোট ছোট লেয়া। তারা সবাই মিলনকে কাছে ডাকে। মিলন ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে
আস্তে আস্তে লেয়াদের দিকে এগুতে থাকে। সবাই মিলনকে বিচিত্র শব্দ দিয়ে
অভ্যর্থনা জানায়। মিলন অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোট ছোট
লেয়াদের মধ্যে মিলনের নিজেকে বেমানান মনে হতে থাকে। মিলন ফিরে যেতে
চায়। ঠিক তখনই লেয়া বলে উঠলো, 'আমার মিশন শেষ। আমি সবাইকে নিয়ে আমার
পৃথিবীতে ফিরে যাব মিলন। তুমি কি আমাদের সাথে যাবে? মিলন বলল, কেন যাব?
ওখানে আমার কেউ নেই।' লেয়া বলল, এখানেও তোমার কেউ নেই।' 'আমাদের
পৃথিবীতে আমরা তোমাদের মতই মানুষ। তবে তোমাদের চেয়ে অনেক
বুদ্ধিসম্পন্ন।' কিন্তু তোমরা তো দেখতে মানুষের মতো নও। তোমরা কাক
মানুষ।' মিলন প্রতিবাদ জানালো। মিলনের কথা শেষ না হতেই সব লেয়ারা মানুষ
হয়ে গেল। একেবারে পৃথিবীর মানুষের মতো। কিন্তু দেখতে অনেক সুন্দর মানুষ।
তুলতুলে, গোলগাল, স্বাস্থ্যবান এবং সুন্দর রেশমি পোশাক পরা মানুষ।
তোমাদের চেয়ে আমরা অনেক সুখি। আমরা যেকোনো সময় অদৃশ্য হতে পারি। যে কোন
সময় ইচ্ছে মতো রূপে বদলে যেতে পারি। তোমাদের পৃথিবী নীল। আমাদের পৃথিবী
গোলাপী। আমাদের পৃথিবীতে কোন অভাব নেই। অনিয়ম নেই, আমরা সবাই সুখী
মানুষ। মিলন খুব গর্ব করে বলল, 'তোমাদের কারো হাতে তো পৃথিবীর মানুষের
মতো মোবাইল যন্ত্রটিই নেই, তোমরা আবার আমাদের থেকে বেশি বুদ্ধিসম্পন্ন বা
এডভান্স হলে কি করে? 'মিলনের কথা শুনে সব লেয়ার দল মিটিমিটি করে হাসতে
থাকে। হঠাৎ মিলনের নিজেকে বোকা বোকা মনে হয়। একটি ছোট্ট লেয়া খুব
শান্তভাবে মিলনের কথার জবাব দিয়ে বলল, 'আমরা ৫০ হাজার বছর আগেই মোবাইল
নামক যন্ত্রটির ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছি। কারণ এটি মানুষের সবকিছু কেড়ে
নেয়। আমরা আকাশের সব গ্রহতারাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উন্নত হয়েছি।
আমাদের মোবাইল আমাদের তারকারাজি। আকাশের অগণিত তারার মাঝে আছে অফুরন্ত
শক্তি। সেই শক্তিকে ব্যবহার করেই আজ আমরা মানুষ হিসেবে সব চেয়ে
শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান প্রাণী। আমাদের শিশুরা তোমাদের মতো অভুক্ত হয়ে
রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না। তাদের সবার মা বাবা আছে।' আরেক লেয়া সামনে
এসে বলল, 'তোমার মত আমাদের একটা মিলনও আছে। সেই মিলন এই মিলনকে দেখে কষ্ট
পাচ্ছে বলেই তো আমরা এখানে এসেছি তোমাকে নিতে। তোমার বন্ধু লেয়া হচ্ছে
আমাদের পৃথিবীতে মিলনের বাবা। মিলনের বাবা তোমাকে নিতে এসেছে। 'তুমি যাবে
আমাদের তারার দেশে?' 'তোমাদের দেশে গিয়ে আমার ভাল লাগবে না।' বলল মিলন।
মিলনের বন্ধু লেয়া জানতে চাইল, 'কেন?' 'কারণ আমাদের পৃথিবীর অনেক
ছেলেরাই কষ্টে আছে। সবাইকে ছেড়ে আমি একা যেতে চাই না। আমি একা ভালো
থাকতে চাই না। মিলনের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। সবার মন খারাপ হয়ে
গেল। ওরা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। সবচেয়ে দেখতে সুন্দর লেয়া এবার
মিলনের সমস্যার সমাধান দিল। ও বলল, 'আমরা তোমাকে শুধু ওখানে নিয়েই যাব
না। বরং তোমাকে এমন কিছু শক্তি দেব যা দিয়ে তোমাদের পৃথিবীর তোমার মতো
সব মিলন বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে। আকাশের তারাগুলোকে কাজে লাগানোর প্রযুক্তি
আমরা ছাড়া মহাশূন্যের আর কেউ জানেনা। সেই শক্তির শক্তি পেতে আমাদের সাথে
চলো মিলন।' ছোট লেয়ার আব্দার শুনে মিলন চিন্তায় পড়ে গেল। 'ওখানে কী
আমি মাকেও পাব?' মিলনের প্রশ্ন। 'হ্যা পাবে তো! সেও তোমার অপেক্ষায়
আছে।' মিলনের তার মায়ের কথা বেশ মনে আছে। মায়ের কথা বলায় মিলনের মন
আনচান করে উঠল। সত্যিই অনেক কষ্ট এ পৃথিবীতে। এখান থেকে চলে গিয়ে যদি এ
পৃথিবীকে ওদের পৃথিবীর মতো উন্নত করা সম্ভব হয় তাহলে এ প্রস্তাব তো মেনে
নেয়া উচিত। দুই পৃথিবীর সবাই ভাল থাকবে আর আমি ফিরে পাব আমার পরিবার।
মিলন নামে আমার আরেক ভাই আছে এ কথা ভাবতেই মিলন বলল, 'আমি যাব তোমাদের
সাথে।' ঠিক এ সময় মাথার উপর চক্কর দিল একটি হেলিকপ্টার। হয়তো এ পৃথিবীর
মানুষ টের পেয়ে গেছে লেয়াদের পরিকল্পনা। মিলনের বন্ধু লেয়া বলল,
'আমাদের এখনই অদৃশ্য হয়ে ককপিটে উঠতে হবে। এ কথা শেষ না হতেই লেয়াদের
মাথার উপর ছায়ার মতো বিশাল কিছু একটি সবাইকে ঢেকে দিল। মিলন নিজেকে একটা
অদ্ভুত সুন্দর রুমে দেখতে পেল। ওর দু'চোখ ভরে ঘুমের নাচানাচি। মিলন পরম
নির্ভরতায় ঘুমিয়ে গেল।
কলি আজ খুব খুশি। সবাই মিলে আজ মেলায় যাবে। কলির সাথে যাচ্ছে মুনা,
টুম্পা, লতা, রিপা মিতুসহ আরো অনেকে। প্রায় পনের জন। স্কুল থেকে ক্লাস
ফাইভের সব মেয়েদের মেলায় নিয়ে যাবার আয়োজন করা হয়েছে। স্কুলে এ
ধরনের আয়োজন আগে কখনো করা হয়নি। পড়ালেখার চাপে হাঁপিয়ে উঠলেও লেখা
পড়ার বাইরে অন্য কিছু করার কথা কারো মাথায় আসেনি। কিন্তু নতুন হেড
টিচার আসার পরে স্কুলে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে ছোট ছোট
সোনামাণিকদের মেলায় নিয়ে যাবার পরিকল্পনা যেন ওদের জন্য চাঁদে ভ্রমণের
সমান। তাইতো সকাল থেকে কলি গোলাপী রঙের জামা, চুলে সাদা ফিতা আর জুতা পরে
স্কুলে যাবার জন্য তৈরি।
মায়ের সাথে কলি স্কুলে পৌঁছে গেল। ক্লাশ ফাইভের মেয়েরা সবাই মেলায়
যাবার জন্য খেলার মাঠে সমবেত হয়েছে। মেয়েদের সাথে মেলা ভ্রমণে থাকবেন
সহকারি শিক্ষক মিজ রাহেলা সুলতানা। সবার মধ্যে আনন্দধারা বইছে। এমন সময়
হেডটিচার সেখানে উপস্থিত। মেয়েদের দিকে তিনি হাসি হাসি মুখে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে থেকে বললেন, 'শুধু বইয়ের ছাপা অক্ষরের মধ্যে শেখার সবকিছু নেই।
বরং তোমাদের শেখার আগ্রহ ও কৌতুহল থাকলে বইয়ের বাইরেও শেখার অনেক উপাদান
আছে। আজ মেলা থেকেও তোমরা অনেক কিছু শিখতে পারবে বলে আমি আশা করি।'
হেডটিচার চলে যাবার পর দলটি নিয়ে মিজ রাহেলা সুলতানা যাত্রা শুরু করলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট মণিদের দলটিকে নিয়ে মেলার টিকেট কাউন্টারে চলে
এলেন। দলটি এক লাইনে দাঁড়িয়ে মিজকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে। ওদের
কলকাকলিতে মেলা প্রাঙ্গন মুখরিত। মেলায় অনেক মানুষ এসেছে। মিজ সবার হাতে
টিকেট ধরিয়ে দিলেন। গোলাপি রঙের স্কুল ইউনিফর্মে ওদেরকে বেশ সুন্দর
লাগছে।
টিকেট হাতে সবাই এখন মেলায় প্রবেশের অপেক্ষায়, ঠিক সেই মুহূর্তে কলির
চোখ আটকে গেল গেটের ঠিক পাশেই বড় সাইজের একটি নীল রঙের বাক্স
কলির চোখ আটকে গেল গেটের ঠিক পাশেই বড় সাইজের একটি নীল রঙের বাক্সের
দিকে। এ বাক্সের উপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে, ' আমাকে ব্যবহার করুন
'। হঠাৎ কলির মনে পড়ল হেডটিচারের কথা। কিছু দিন আগে তিনি বলেছিলেন,
'আবর্জনা যখন আবর্জনার নির্দিষ্ট স্হানে ফেলবে তখন তা আর আবর্জনা থাকবে
না। পরিবেশ ভালো রাখতে আবর্জনা নির্দিষ্ট স্হানে ফেলবে।' তাহলে ঐ নীল
রঙের বাক্সটাই কী আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট স্হান? কলি ওর হাতে ধরা
টিকেটের দিকে তাকিয়ে ভাবল টিকেটের কাজ শেষ। এটি এখন নেহায়েত আবর্জনা।
কলি দৃঢ় পায়ে নীল বক্সের দিকে এগিয়ে গেল। টিকেটের কাগজটা নীল বক্সের
মধ্যে ফেলে দিল। ওর দেখাদেখি সবাই টিকেট নীল বাক্সে ফেলে দিয়ে নিজেদের
ভালো কাজের আনন্দে নিজেরাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ওদের মনে হলো নীল
বাক্সটিও যেন ওদের সাথে হাসিতে যোগ দিয়েছে। মেলায় আগত লোকজন ওদের দিকে
কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। দূরে দাঁড়িয়ে মিজ বিষয়টি খেয়াল করলেন।
তিনি ওদের পিঠে হাত বুলিয়ে সবাইকে নিয়ে গেটের ভিতরে চলে গেলেন। এবার
সবার মাথা গোনার পালা। মিজের মাথা গণনা শেষ হলো। একটি মাথা পাওয়া গেল
না। মিজ অস্হির হয়ে গেটের দিকে ছুটে গেলেন। মিজ দেখলেন কলি নীল বাক্সের
পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। মিজ কলিকে পেয়ে যেন
আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। একটু কঠিন স্বরে বললেন, 'কলি কী হয়েছে? 'তুমি
তো হারিয়ে যাবে!' কলি সাথে সাথে উত্তর দিল, 'নীল বাক্সের মন খারাপ। কারণ
ওকে কেউ খাবার দিচ্ছে না।' মিজ ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। 'নীল বাক্স তো
খেতে পারে না। ওকে আবার কে খাবার দেবে?' কলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
'ছেঁড়া টিকেটগুলোই তো ওর খাবার। কেন সবাই টিকেটের ছেঁড়া অংশটা মাটিতে
ফেলে দিচ্ছে?' এতে তো মাটি নষ্ট হচ্ছে, সাথে পরিবেশও।' মিজ আদর করে কলির
হাত ধরে ওকে কাছে টেনে নিলেন। 'আচ্ছা এবার চলো।' আমরা আগামীকাল ক্লাসে এ
বিষয় আলোচনা করে একটা উপায় বের করবো। এখন চলো। সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা
করছে।'
কলি মিজের হাত ধরে মেলার গেট পেরিয়ে বন্ধুদের সাথে যোগ দিল। সবাই কলিকে
পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো। মিজ সবাইকে গোলাকার বৃত্তে সাজিয়ে নিজে বৃত্তের
মধ্যখানে দাঁড়িয়ে বললেন, 'আজকে আমরা কৃষি ও বৃক্ষ মেলায় এসেছি। এ
মেলায় তোমরা অনেক নাম না জানা গাছের নাম জানবে। এছাড়া আমাদের ধান
ক্ষেতে যারা সোনার ফসল ফলায়, তাদের কৃষি কাজে যেসব যন্ত্রপাতি প্রয়োজন
হয়, সেসব যন্ত্রপাতি দেখার সুযোগ পাবে এ মেলায়।' এ ধরনের মেলায় আগে
কখনো ওরা আসেনি। মেলায় একদিকে গাছ গাছালি দিয়ে সাজানো গাছের খোলামেলা
স্টল। স্টলে আছে নানা ধরনের ছোট, বড়, মোটা, চিকন গাছ। এক এক গাছের পাতা
এক এক রকম। সবুজ রঙের মধ্যেও আবার অনেক ভিন্নতা। গাছের পাতাগুলো বাতাসে
দুলে দুলে ওদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। অন্যান্য মেলার চেয়ে এ মেলা অনেক
আলাদা। মেলার অন্য পাশে সাজানো আছে কৃষি কাজের যন্ত্রপাতির স্টল। এসব
যন্ত্রপাতি ওরা আগে কখনো দেখেনি। তাই কৌতুহল নিয়ে যন্ত্রপাতি দেখায়
ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়েরা। মেয়েদের আগ্রহ বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে
প্রদর্শনীর জন্য তৈরি ফুলের বাগানের সামনে ওদেরকে ঠিক ফুলের মতোই সুন্দর
লাগছে। হঠাৎ টুম্পা খেয়াল করলো কলির মুখে কোন হাসি নেই। কলি কিছু একটা
খুঁজে বেড়াচ্ছে। গেটের পাশে রাখা নীল বাক্সের মতো বাক্সই খুঁজছে কলি।
কলি পেয়ে গেল বেশ কয়েকটি নীল বড় সাইজের বাক্স। সবগুলো নীল বাক্সই
ক্ষুধার্ত চোখে পলির দিক চেয়ে আছে! কলি নীল বাক্সগুলোর জন্য খাবার
খুঁজছে। কলি মেলার বিরাট মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখলো পুরো মাঠ ছেয়ে আছে
শুধু খাবার আর খাবার। অসংখ্য ছেঁড়া কাগজের টুকরা, চিপসের রঙিন প্যাকেট,
আইসক্রিম ও চকলেটের খোসা আর পলিথিন। এরা হলো নীল বাক্সের জন্য মজার মজার
খাবার। এ যেন খাবারের রাজত্ব। মেলায় আগত মানুষের পায়ে পায়ে এ সব খাবার
দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। মেলার সৌন্দর্য্য সবাইকে মুগ্ধ করলেও নীল
বাক্সের শূন্যতা আর মেলা প্রাঙ্গণের ছেঁড়া কাগজের টুকরা ও অন্যান্য
আবর্জনার স্তূপ কলির মেলা দেখার আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছে। কলির চিন্তায়
ছেদ পড়ল। মিজ কলিকে ডেকে চলেছেন। মেলায় জমে উঠেছে হরেকরকম প্যাকেটজাত
খাবারের দোকান। সে সব খাবার খেতে ডাক পড়েছে সবার। মিজ কলির দিকে বেশি
নজর দিচ্ছে। কলি অন্য মেয়েদের মতো কোনো কিছুতেই আনন্দ পাচ্ছে না-
বিষয়টি মিজের নজর এড়ায়নি। সবার সাথে কলি গেল ফাস্টফুডের দোকানে। এখানে
এসে চোখে পড়ল আরো খারাপ দৃশ্য। সবাই খেয়ে খাবারের খোসা, আধ খাওয়া
খাবার ইত্যাদি সরাসরি নীচে ফেলে দিচ্ছে। 'আমাকে ব্যবহার করুন' বলে নীল
বাক্সের আকুতি যেন কারো নজরে আসছে না। এ উদাসীনতা আর সহ্য করা সম্ভব না।
হঠাৎ কলি যেন বদলে গেল। নিজের হাতের টিস্যু পেপারটা নীল বাক্সে ফেলে
দিয়ে মাটিতে বসে টিকেটের ছেঁড়া অংশ, কাগজের টুকরা, চকোলেট ও আইসক্রিমের
খোসা, চিপসের প্যাকেট, টিস্যু পেপার ইত্যাদি মাটি থেকে কুড়িয়ে নীল
বাক্সে ফেলতে লাগলো। মুনা, রিপা, টুম্পা, লতা ওরা কলির দিকে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো, 'Let's go' মূহুর্তের খাবার দোকানের
চারপাশ পরিস্কার হয়ে গেল। সবাই অবাক চোখে ছোট ছোট মেয়েদের এসব কাজ দেখে
অবাক হলো। দোকানের মালিক ও আশেপাশের ছোট বড় সবাই বেশ লজ্জিত হলো। ছোট্ট
সোনামণিরা ওদের ভুল ধরিয়ে দিল। মিজ এবার মেয়েদের মধ্যে এসে ওদের
জড়িয়ে ধরলেন। এসময় সবাই একসাথে ওদের জন্য হাতেতালি দিয়ে ধন্যবাদ
জানালো। কলি বলে উঠলো, আমাদের নীল বাক্সগুলোর পেট ভরেছে। 'সবাই দ্যাখো
ওরা এখন হাসছে!'
গ এর ই এর পরিচয় বহুদিনের। দুজনের বয়সের পার্থক্য অ--নে--ক। গ বড় । ই
ছোট। গ নিরীহ ও ক্ষমতাহীন। ই চালু এবং ক্ষমতাধর। গ এর জন্ম প্রকৃতিতে। আর
ই এর জন্ম মানুষের হাতে। একদিন পথে দুজনের দেখা। এমনটা ছিল তাদের দুজনের
কথোপকথন:
গ: কেমন আছো ভাই ই?
ই: আমি আবার কবে থেকে তোমার ভাই হলাম? ভাল আছি। তুমি কেমন আছো?
গ: দিন দিন আমি খারাপের দিকে যাচ্ছি। আর কত দিন বাঁচি তা বলতে পারছি
না।
ই: কেন? তোমার সমস্যা কি? তোমাকে তো ভালই দেখছি। সবুজ পোশাকে তোমাকে বেশ
লাগে। তবে তোমার পোশাকটা অনেক পুরানো হয়ে গেছে। বেশ ফ্যাকাশে লাগছে।
গ: অথচ দ্যাখো ই এ মাত্র কয়েক বছর আগেও এ পোশাকটা দেখে তুমি কত যে
প্রশংসা করেছিলে, ভুলে গ্যাছো?
ই: তাই তো! এই কয়েক বছরের মধ্যে পোশাকের এ হাল করলে কী করে?
গ: আমার পোশাকই শুধু দেখলে! আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো। আমার
শরীর দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
ই: ঠিকই বলেছো। এখন দেখছি তোমার হাত পাগুলো কেমন চিকন লিকলিকে দেখাচ্ছে।
তোমার কোন কঠিন অসুখ হয়নিতো!
গ: ঠিক জানিনা। তবে নিশ্চয়ই কঠিন কিছু!
ই: কোনো ভাইরাস তোমার শরীরে বাসা বাঁধে নিতো? না ভাই, তোমার সাথে
বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক হবে না।
গ: তা খুব একটা অসম্ভব না। এখন ভাইরাসের বিস্তার অনেক বেশি। কিন্তু তুমি
আমাকে ফেলে যাবে কোথায়? তোমার আমার বাসা তো একই পাড়ায়।
ই: (চিন্তিত) আসলে আমার কোথায় যেতে হবে না। পাশাপাশি থাকলেও এসব ভাইরাস
আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমার বডিতে immunity বেশি। আমার সুবিধা
একটাই।
গ: কী সুবিধা তোমার?
ই: আমার কোনো ক্ষয় নেই। আমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাব। কিন্তু মিশে যাব
না। আর আমাকে কেউ মেরেও ফেলতে পারবে না। কেউ মেরে ফেলতে চেষ্টা করলে আমি
তোমাদের মতো বন্ধুর শরীরের ভিতরে লুকিয়ে পড়বো। এখন বলো আমার চেয়ে
শক্তিশালী আর কে আছে?
গ: নিশ্চয়ই। তোমার ক্ষমতা অনেক। অথচ দ্যাখো আমরা কত অসহায়। আমি, আমার
সহোদর ভাই-বোন, কাজিন এমন কী আমাদের বাবা চাচা মামা খালা সবাই অসহায়ের
মতো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কী.....।
ই: তুমি মনে হচ্ছে আমাকে কিছু বলতে চাও। তা এত ভনিতা না করে বলেই ফ্যালো
না। তাছাড়া তোমার ভাই-বোন মামা চাচাদের আবার কী হলো? ওদের নিয়ে তুমি এত
ভাবছো কেন? ওদের ও কী তোমার মতো ভাইরাসের আক্রমন হয়েছে?
গ: সত্যি বলতে কি ওরাই আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে পাঠিয়েছে।
ই: তাই নাকি! তাহলে তো সমস্যা সত্যিই গুরুতর।
গ: কীভাবে শুরু করি তা নিয়ে ভাবছি।
ই: এই তোমরা ভাবতেই সময় পার করে দাও। আমার কিন্তু এত সময় নেই। যা বলার
তা ঝটপট বলে ফ্যালো।
গ: এই ধরো আমিও মাটিতে বাঁচি তুমিও মাটিতে থাকো। আমার জন্ম মাটিতে। আর
তুমি মাটিতে আসো যখন তোমার মালিকের কাছে তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
ই: কী এত বড় কথা! আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় এ কথার মানে কি?
গ: রেগে যেও না ভাই। আমি বলতে চাচ্ছি তোমরা দিন দিন এত এডভ্যান্চ হচ্ছো
যে তোমাদের মালিক নতুন নতুন ই দের ব্যবহার করার জন্য পাগল হয়ে যায়। আর
তখন একটু কম এডভান্চ ই দের আমাদের কাছে রেখে যায়। কেউ কেউ আবার ছুঁড়ে
ফেলে দ্যায়। তোমরা কিন্তু এখানে এসে দিব্বি ভাল থাকো। মরে যাও না।
ই: তুমি তো দেখি ইতিহাস শুরু করলে! আমি এ সব কথা শোনার জন্য আসিনি।
গ: তবুও তোমাকে অনুরোধ করছি। আমাদের দুজনের ভবিষ্যতের জন্য তোমাকে আমার
কথা শুনতেই হবে।
ই: কী যেন বলছিলে? আমরা মরে যাই না- এ কথার অর্থ কী?
গ: এ কথার অর্থ হচ্ছে তোমাদের শরীর অনেক শক্ত ও মজবুত থাকে। শক্ত ও মজবুত
শরীরের ভিতরে থাকে অনেক নরম ও অদৃশ্য শক্তি। ওসবের আবার অদ্ভুত সব নাম
আছে। সেসব নাম আমি ভালভাবে বলতে পারি না।
ই: খুব interesting তো! তুমি এত কথা জানলে কী করে?
গ: বাঁচতে হলে জানতে হবে। নইলে তুমি আমি আর আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী
একদিন হারিয়ে যাবে। তোমাদের ভিতরে যেসব শক্তি আছে তার নাম জানতে গিয়ে
আমার বড় চাচার কথা মনে পড়ে গেল। চাচা তো তোমাদের অদৃশ্য শক্তির কারণেই
গত বছর মারা গেল।
ই: তুমি কিন্তু আবার আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছো।
গ: চাচার মারা যাবার কারণ জানলে তুমি আর রাগবে না। বরং কষ্ট পাবে।
ই: কীভাবে মারা গেলেন তোমার চাচা।
গ: চাচা আমার মতোই দুর্বল হয়ে যেতে যেতে একদিন মরে গেল। মাটি থেকে চাচা
কোনো খাবার খেতে পারতো না। মাটিকে চাচা বিষ বলে গালাগাল করতো। আমরা এসবের
কোনো অর্থ খুঁজে পাইনি। তবে চাচা মারা যাবার মাসখানেক পরে টিভিতে আমাদের
নিয়ে অনেক হৈচৈ শুরু হলো। তখনই চাচার মৃত্যুর কারণ জানতে পেরেছি।
ই: কী সে কারণ?
গ: বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থেকে রেডিয়েশনের কারণেই চাচার মৃত্যু
ঘটেছে। শরীরের প্রতি কোষে কোষে এসব ছড়িয়ে পড়েছে বলেই চাচা মারা
গেল।
ই: কিন্তু ওগুলো কি? আর এলোই বা কোথা থেকে?
গ: সেটা তো আমাদেরও প্রশ্ন। মাটি আমাদের মা। সেই মাটিই কিনা চাচার
মৃত্যুর কারণ?
ই: ভাবনার বিষয়। তোমার আমার মালিকরা এ নিয়ে কী ভাবছে?
গ: মালিকরা ভাবছে তোমাদের বাসস্হান পৃথিবীর মাটিতে নয়। বরং আরো উন্নত
কোনো স্হানে হওয়া দরকার।
ই: তুমি কি বলতে চাচ্ছো? আমাদের প্রজাতির কারণে তোমরা মরে যাচ্ছো?
তোমাদের অস্তিত্ব আমাদের কারণে বিলীন হচ্ছে?
গ: টিভির খবরে তো সে রকমই বললো যে, ই প্রজাতির বসবাস মাটিতে হওয়ার
কারণেই ওদের ভিতরের অদৃশ্য শক্তি থেকে উৎপন্ন রেডিয়েশনই আমাদের মৃত্যুর
মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
ই: তোমার এ কথা আমি মেনে নেব কেন?মাটিতে বসবাস আমাদেরও তেমন পছন্দ না।
আমাদের অন্য কোথাও যাবার উপায় নেই বলেই মালিকরা মাটিতেই আমাদের ফেলে
রাখে। কিন্তু এখন তো দেখছি আমাদের কারণে মাটি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
মাটির সবাইতো একদিন মরে যাবে।
গ: তুমি বুঝতে পেরেছো বন্ধু আমার! শোন, শুধু মাটি নয়। সব নদী ও জলাশয়েও
তোমাদের দেখা মিলছে। আমার অতি প্রিয় বন্ধু ম এর সাথে দেখা হয়েছিল। ও তো
প্রায় মরতে বসেছে।
ই: তাই নাকি?
গ: অনেক দিন পর তোমাকে সব বলতে পেরে খুব হালকা লাগছে।
ই: আমরা কি করতে পারি? আমাদের তো কথা বলার শক্তি নেই। কীভাবে আমাদের এ
জীবনমরণ সমস্যা মানুষ অর্থাৎ মালিকদের বোঝাবো?
গ: ভয় পেয়ো না বন্ধু! মানুষের মধ্যে যাদের অনেক বুদ্ধি আছে যেমন ধরো
বিজ্ঞানী, গবেষক, পরিবেশবাদী তারা ইতিমধ্যে এ নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনা শুরু
করে দিয়েছে। দেশ বিদেশে অনেক সভা, সমিতি, কর্মশালা হচ্ছে। কিন্তু এখন
পর্যন্ত যুতসই কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না।
ই: মানুষ কেন এসব নিয়ে এত চিন্তিত? তাদের তো কোন সমস্যা নেই। তারা তো
দিব্যি ভালো আছে। নতুন নতুন আবিষ্কার করে আরও আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছে।
আগের যুগের মানুষ আর এখনকার মানুষের মধ্যে কত পার্থক্য!
গ. বন্ধু তুমি তো অনেক খবরই জানো না! ইদানিং মানুষের রক্তের ভিতরে এ
ধরনের অবাঞ্ছিত পদার্থ পাওয়া গেছে। অনেক অজানা রোগে মানুষের মৃত্যু
হচ্ছে। তাই মানুষ এর মূল কারণ হন্যে হয়ে খুঁজছে। কাজেই এই বিষয়টি আর
হালকাভাবে নেবার সুযোগ নেই। যেখানে মানুষের জীবন মরণের প্রশ্ন সেখানে
সমাধান তো খুঁজে বের করতেই হবে। আর পৃথিবীতে আমরা অর্থাৎ গ প্রজাতি না
থাকলে মানুষের বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই। মানুষ তো নি নিঃশ্বাস নিতে না
পারলেই মরে যাবে।
ই: তাহলে এই পৃথিবীর কি হবে?
গ: কঠিন প্রশ্ন। পৃথিবীতে কোন প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে না। এভাবে একদিন
এই মাটির পৃথিবী হারিয়ে যাবে।
ই: ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকারাচ্ছন্ন। চলো আমরা দুজন মিলে কিছু একটা করি
যাতে মানুষ এ ব্যাপারে খুব দ্রুত একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
গ. হাহাহা। তুমি আমাকে হাসালে। তোমাদের অর্থাৎ ই প্রজাতিদের মাটির
পরিবর্তে মহাশূন্যে রেখে এলে কেমন হয় বন্ধু?
ই: তোমাদের ছেড়ে মহাশূন্যে যেতে অনেক কষ্ট হলেও পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য
আমরা যেতে রাজি আছি। এ সুন্দর পৃথিবীকে আমরা দূর থেকে দেখতে তো পাবো।
পৃথিবী হারিয়ে গেলে..... না আর ভাবতে পারছি না।
গ. অথবা তোমাদের শক্তিগুলো অন্য কোনোভাবে কাজে লাগানোর কথা মানুষ চিন্তা
করতে পারে। মানুষের মাথায়তো অনেক বুদ্ধি!
ই: সেটা কি রকম?
গ. যেমন ধরো তোমার শক্তিগুলোকে রিসাইকেল করে বিদ্যুৎ অথবা জ্বালানি তেল
উৎপাদন উৎপাদন করলো।
ই. এসব করা কঠিন কাজ। আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে। আমাকে এমনভাবে তৈরি
করবে যাতে এক ই সারাজীবন মানুষ ব্যবহার করতে পারে। এডভান্স টেকনোলজি
ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরানো টেকনোলজিকে বাদ না দিয়েই এডজাস্ট করে নিতে
পারে।
গ. এগুলো সবই আমাদের চিন্তাভাবনার ফসল। মানুষকে বোঝাবো কি করে?
ই. আমি হয়তো চেষ্টা করলে এ কাজটি করতে পারব। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলার
ছলে এই জিনিসগুলো বোঝানোর জন্য আমার কিছু কৌশল জানা আছে সেগুলোই ব্যবহার
করব।
গ. বেশ ভালো। রোবট কাজে লাগাতে পারো।
অনেক কথা হলো। চলো এবার আমরা একে অপর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। তাহলে
হয়তো আমরা নিজেরা ভালো থাকবো।
গ. কিন্তু মাটির কি হবে? তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।
যারা গল্পটি পড়েছো তারা কি বলতে পারো গ আর ই এর আসল পরিচয়?
আমি বলে দিচ্ছি গ হলো গাছ আর এই হলো ইলেকট্রনিক ওয়েস্ট অর্থাৎ সব ধরনের
কম্পিউটার মোবাইল ইত্যাদির বর্জ্য। ম এর কথা ভুলে যাওনি তো। ম হলো
মাছ।
তিন দিন ধরে টুম্পা কারো সাথে কথা বলছে না। কলেজে যাওয়া বন্ধ। কলেজের
বন্ধু-বান্ধবের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে। টুম্পাকে নিয়ে
সবাই বড্ড বিপদে আছে! টুম্পার মা বাবার চিন্তার শেষ নেই। খাবার টেবিলে মা
টুম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,' তোর সমস্যা কী? কেউ খারাপ কিছু
বলেছে?' টুম্পা নির্লিপ্ত মুখে বসে আছে। মুখে কোনো কথা নেই। 'এতো দেখি
মহা বিপদ!' টুম্পার মায়ের চেহারায় অসহায়ত্ব। কয়দিন আগে যে মেয়েটি
বন্ধু- বান্ধব নিয়ে আনন্দে ফু্র্তিতে সময় কাটিয়েছে, আজ হঠাৎ করে তার
কী এমন হতে পারে যাতে খাওয়া দাওয়া বন্ধ, সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ, এমনকি
মোবাইল ফোনেও কারো সাথে কথা বলতে শোনেননি তিনি। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা
অস্বাভাবিক লাগছে। টুম্পার মতো হাসিখুশি একটা মেয়ে এমন চুপচাপ হওয়ার
পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। কার মাধ্যমে এই রহস্য
উদঘাটন করা যেতে পারে তাই নিয়ে তিনি ভাবতে ভাবতে ছেলের দরজায় টোকা
দিলেন। 'সত্যি করে বলতো টুম্পার কী হয়েছে? ওর সাথে তোর কোনো ঝগড়া
হয়েছে?' সামি টুম্পার ছোট ভাই। দুজনের বয়সের ডিফারেন্স মাত্র দুই বছর।
টুম্পার এইচএসসি পরীক্ষা সামনে আর সামির এর পরের বছর। মাথা নাড়িয়ে সামি
বলল, ' জানি না। তবে বন্ধু বান্ধবের সাথে কোনো জটিল সমস্যা চলছে।' সেটা
হতে পারে কোনো অন লাইন সংক্রান্ত সমস্যা। আমি ঘটনা জানার অনেক চেষ্টা
করেছি। কিন্তু টুম্পা কোনো কথাই বলছে না।' অন লাইন সংক্রান্ত? সেটা আবার
কী?' মায়ের চোখ রীতিমত কপালে উঠে গেল। 'আমাকে বলেছিল একটা ফেসবুক পেজ
খুলেছে। সেখানে টুম্পা নিজের আঁকা ছবি আপলোড করে বেশ সাড়া পেয়েছে।
অনেকে টুম্পার আঁকা ছবি কেনার অফারও দিয়েছে।' এসব নিয়ে ও খুব ব্যস্ত
ছিল। এমনকি পড়াশোনাও ঠিকঠাক মতো চলছিল না। এর মধ্যে আবার নতুন কী হলো
ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না কেউ। সামি ও টুম্পার মা ভাবছে এর পরের স্টেপ কী
হবে! কোন পথে এগুলে অন লাইনে টুম্পার সাথে কী হয়েছে তা জানা সম্ভব হবে।
'সামি চল আমরা কারো পরামর্শ নেই। এসব বিষয়ে কে আমাদের বুদ্ধি দিতে পারে
সেটা খুঁজে বের করতে হবে।' সামি তাৎক্ষণিকভাবে বলল, ' আমরা তুহিন ভাইয়ের
কাছে যেতে পারি। উনি এ সব বিষয়ে ভাল বলতে পারবে।' তুহিনকে এ মহল্লার
সবাই কমবেশি চেনে। ইদানিং 'নবারুণ' নামের যুব ক্লাবের কম্পিউটারে এলাকার
ছেলেদের ভিডিও দেখিয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু মা কিছুক্ষণ
চিন্তা-ভাবনা করে বলল, 'না, এখনই ওকে কিছু বলতে হবে না।' মেয়েদের বিষয়ে
মায়েরা একটু বেশি চিন্তা করে। সামি এটা আগেও লক্ষ্য করেছে। সামি অপেক্ষা
করছে মা কী বলেন, কী প্রস্তাব আসবে মায়ের কাছ থেকে। মাকে কেমন যেন
অস্হির দেখাচ্ছে। 'টুম্পার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম জানিস সামি? অথবা
সবচেয়ে অপছন্দের বন্ধুর নাম?' 'কেন? সামি অবাক হয়ে জানতে চাইলো। 'ওদের
সাথে কথা বললে একটা না একটা ক্লু পাওয়া যাবে তাই।' মায়ের চোখে আশার
ঝলক। 'ইভানা বা ইভু নামের খুব কাছের একজন বান্ধবী আছে' মা নিজেই বিড়
বিড় করে বলতে লাগলেন। ইভু দুই একবার টুম্পার জন্মদিনে তাদের বাসায়
এসেছিল। মা ইভুকে মনে করতে পেরে যেন সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন- এমন
ভাব করলেন। 'সামি দেখতো কলে-কৌশলে ইভুর ঠিকানাটা টুম্পার কাছ থেকে নিতে
পারিস কিনা' মায়ের গলায় স্পস্ট আকুতি শুনতে পেল সামি। যেই কথা সেই কাজ।
প্লান হলো বিকেলে ইভুদের বাসায় যাওয়ার।
ইভুর মা দরজা খুললেন। যথারীতি সালাম বিনিময়ের পরে একথা সেকথা বলার পরে
ইভুর মা বললেন, ' আপা আমি ভাবছিলাম আপনার বাসায় যাব। ইভু আর টুম্পার
মধ্যে কী হয়েছে কিছু জানেন? টুম্পার ওপর ভীষণ রেগে আছে ইভু।' 'টুম্পাওতো
বাসায় ভুতে পাওয়া মানুষের মতো আচরণ করছে। সে জন্যই তো আমি আপনার কাছে
এলাম।' টুম্পার মায়ের কথা শুনে ইভুর মা হতবাক! দুজনেই ইভুকে ডেকে
বিষয়টি খোলাসা করা ঠিক করলেন। খুব আদর আদর গলায় ইভু ইভু করে তাকে
ডাকছেন ওর মা। টুম্পার মাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল ইভু। সালাম দিয়ে
বলল,' কেমন আছেন আন্টি? 'তুমি কেমন? লেখাপড়া কেমন চলছে?' বলল,
'মোটামুটি'। 'তুমি কি টুম্পার সাথে রাগ করেছো?' টুম্পার মা কোন ভূমিকা
ছাড়াই আসল কথায় চলে এলেন। ইভুর বিষন্ন মুখটি আরো বিষন্ন হয়ে গেল! না
না না। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে ইভু। অনেক ধরনের প্রশ্ন, প্রশংসা গল্প
ও ঘটনা বলে পরিবেশ স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টার পরে মুখ খুলল ইভু।ওর
দুঃখ যেন উছলে উঠলো। বলল,' 'আন্টি টুম্পা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু এখন
সে আমাকে চেনেই না! আমরা দুজনেই যাকে পছন্দ করতাম না, টুম্পা তার সাথে
মিলে আমাকে অপমান করছে। আমাদের মধ্যের সব কথা ওকে বলে দিচ্ছে। টুম্পার মা
বলল, ওর নাম কী?' প্রথমে নাম বলতে চাইল না। পরে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের
পর বলল,' জাইমা'। জাইমার সাথে যোগ দিয়েছে নাইমা, বীথি, অনি। ওরা সবাই
মিলে আমাকে সবসময় অপমান করছে। এ সব কিছুর কারণ টুম্পা। টুম্পার জন্য সব
হচ্ছে। অথচ টুম্পা আমার.... কাঁদতে কাঁদতে ইভু দৌড়ে চলে গেল। 'আজব
ব্যাপার! ওদের সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি নেই অনেক দিন। তাহলে এ সব কীভাবে
সম্ভব! সামনাসামনি দেখাদেখি ছাড়া একজন আরেক জনকে অপমান করে কি করে!' এসব
কথাগুলো টুম্পার মায়ের মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে আসছে। ইভুর মা শুধু
বললেন, 'কি সব দিনকাল! নেটওয়ার্ক, ফেসবুক ইত্যাদি ওদের মাথাটা খেলো!
হাল ছাড়া যাবেনা। টুম্পার মায়ের মুখে একটা সংকল্পের ছাপ ফুটে উঠলো।
তাকে যে করেই হোক জাইমার সাথে কথা বলতে হবে। আবারও সামিকে মোবাইল নম্বর ও
ওদের বাসার ঠিকানা জোগাড় করার দায়িত্বটা দেয়া হলো।
'হ্যালো হ্যালো জাইমা আমি তোমার আন্টি, টুম্পার আম্মু, কেমন আছো?' ওপাশ
থেকে জাইমার কন্ঠ ভেসে এলো 'ভালো আছি আন্টি। আপনি কেমন আছেন।' গলায় বেশ
খুশির আমেজ। 'টুম্পার সাথে এখন আমার অনেক বন্ধুত্ব। ও কেমন আছে।' 'হঠাৎ
তোমাদের নতুন বন্ধুত্বের কথা শুনেই তো তোমাকে ফোন করলাম। 'ইদানিং ওর মন
খারাপ দেখছি। তুমি কী জানো টুম্পা কেন এত মনমরা হয়ে থাকে?' টুম্পার মা
বেশ কৌশলী হয়ে জাইমার কাছ থেকে সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার
প্রাণবন্ত মেয়েটি যেন আবার আগের মতো উচ্ছলতায় বাসাটা ভরিয়ে তোলে এই
তার প্রত্যাশা। জাইমা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শুধু বলল, 'আমি টুম্পার
সাথে কথা বলে আপনাকে জানাব আন্টি।' 'তুমি কিছু জানলে আমাকে বলো জাইমা।'
'আমি কিছু জানি না। তবে ওর পাশ ওয়ার্ড কেউ পেয়ে গেছে বলে শুনেছি।'
এসবের কোন অর্থই টুম্পার মা বুঝতে পারছে না। সমস্যা জটিল থেকে জটিল
হচ্ছে। কিন্তু এ রহস্য তো তাকে উন্মোচন করতেই হবে। এবার তাহলে তুহিনের
সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এর মধ্যে আরও দুদিন চলে গেল। সামিকে নিয়ে
নবারুণ ক্লাবে হাজির টুম্পার মা, আসিফা আকতার। ক্লাবের ছেলেদের কী যেন
বুঝাচ্ছিল তুহিন। ওদের সামনে একটি কম্পিউটার। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এ
ছেলে তো দেখি বেশ বড় হয়ে গেছে! সামি ডাকল, 'তুহিন ভাইয়া, মা তোমার
সাথে কথা বলবে।' তুহিন ভাই হাত ইশারায় আসছি বলে কিছুক্ষণের মধ্যে এসে
মাকে লম্বা সালাম দিয়ে বলল, 'খালাম্মা আপনি বললে তো আমি বাসায় গিয়ে
আপনার সাথে কথা বলতে পারতাম।' 'না বাবা তার দরকার নেই। টুম্পার মা তুহিন
ভাইকে ঘটনার আদ্যপান্ত সংক্ষেপে বললেন। তুহিন ভাই বিষয়টা বুঝে ফেলেছেন।
তুহিন ভাই কয়েক মিনিট চুপ করে বসে থেকে বললেন, 'যা ভেবেছি ঠিক তাই
হয়েছে। টুম্পা নামে কেউ ফেক আইডি দিয়ে নেটে টুম্পাকে ব্যবহার করছে।' তা
কিভাবে সম্ভব!' টুম্পার মা চেয়ার ছেড়ে প্রায় দাঁড়িয়ে গেলেন।
'খালাম্মা এই নেট যুগে স-ব সম্ভব। আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি। ঘাবড়াবেন না।
শান্ত হোন।' তুহিন ভাইকে বিপদের বড় বন্ধু মনে হলো। টুম্পার মায়ের
অপেক্ষা সইছে না। তিনি বললেন, 'কোন বিপদে পড়েছে আমার টুম্পা?' 'কিছুটা
সে রকমই।' তুহিন ভাই বলতে লাগলেন, ' আপনার চেনা-জানা নেই, এমন কাউকে কী
আপনি আপনার ঘরে ঢুকাবেন? তাকে আপনার আলমারির মূল্যবান জিনিসপত্রের খবর
জানাবেন? কোন্ কাজে আপনার সুনাম হচ্ছে, কোথা থেকে টাকা আয় হচ্ছে- এসব
খবর জানাবেন? এসব খবর বা তথ্য একান্ত আপনজন ছাড়া আমরা কাউকে বলি না,
তাইতো? 'ঠিক তাই।' সম্মোহিত মানুষের মতো তুহিনের কথায় সায় দিয়ে
যাচ্ছেন টুম্পার মা। 'অন লাইন বা নেট জগতে এরকম হাজার হাজার মানুষ আছে
যাদের আমরা চিনি না। নেট জগতে একটি ঘর আছে যার নাম ফেসবুক। এই ফেসবুকে
টুম্পার একটা ছোট ঘর আছে। সেই ঘরের চাবি টুম্পার কাছে। তালা খুলে দিয়ে
ফেসবুকের সেই ঘরে টুম্পা যে কাউকে আমণ্ত্রণ জানাতে পারে। এখানেই ঘটে যত
সমস্যা। এই ঘরে ঢোকার জন্য যে কেউ বন্ধু হবার অনুরোধ জানাতে পারে। কিন্তু
অপরিচিত কারো অনুরোধে সাড়া দেয়া একেবারেই উচিত নয়। টুম্পা সম্ভবত এমন
কাউকে বন্ধু বানিয়েছে যার উদ্দেশ্য খারাপ। অচেনা কাউকে আমণ্ত্রণ জানিয়ে
টুম্পা হয়তো তার সব তথ্য জানার সুযোগ করে দিয়েছে সেই অচেনা বন্ধুকে। আর
তাতেই ঘটেছে অঘটন। অচেনা বন্ধুটিই আসল টুম্পা সেজে টুম্পা হিসেবে বিভিন্ন
পোস্ট দিচ্ছে যে সব পোস্ট মোটেই আপনার আদরের মেয়ে টুম্পার কথা বা ছবি
নয়। টুম্পার সত্যিকারের বন্ধুরা সে সব পোস্টের ছবি, কথা, ভিডিও দেখে
বিব্রত, ভাবছে টুম্পা কেন নোংরা কথা ও ছবি পোস্ট করছে!
এতক্ষণ টুম্পার আম্মা খুব মনোযোগ সহকারে এসব কথা শুনছিল। কিন্তু এবার
তিনি একটি প্রশ্ন করলেন, 'তাহলে টুম্পার বন্ধু ইভু কেন রাগ করে আছে?
জাইমা কেন হঠাৎ টুম্পার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেল? 'এমন হতে পারে জাইমাই এসব
করছে! হয়তো কোনো কারণে ওদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে অথবা ইভু
টুম্পার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোক এটা জাইমা সহ্য করতে পারছে না। এমন হতে পারে
ছবি এঁকে টুম্পার নামডাক হচ্ছে এটা কেউ সহ্য করতে পারছে না। এবার আশা করি
সব বিষয় আপনার পরিষ্কার হয়েছে খালাম্মা।' 'হুম। ' খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর।
টুম্পার মা ভাবছেন ফেসবুকের মালিক কে, মালিককে এই ফেসবুক নামক ঘরের
নিরাপত্তাহীনতার কথা বলা যায় না? মনে মনে এই সব কথা ভাবছেন আসিফা
আক্তার। কিন্তু এসব কথা এ ছেলের কাছে জানতে চাওয়া ঠিক হবে না এটাও তিনি
বুঝতে পারছেন। তুহিন ভাই বেশ আন্তরিকভাবে বলল,' চলো সামি তোমাদের এগিয়ে
দিয়ে আসি।' টুম্পার মা নিজেকে দোষারোপ করেই চলেছেন। কেন তিনি মেয়ের
সাথে সাথে কম্পিউটারে বসে ফেসবুক নামক ঘরটা আগেই দেখে নিলেন না। মেয়ের
বিপদের বিষয়ে কেন তিনি সচেতন হলেন না ইত্যাদি চিন্তায় তিনি এতটাই মগ্ন
হয়ে পড়েছিলেন যে কখন বাসায় পৌঁছে গেলেন তা টেরই পাননি। সামিকে বললেন,
এখন থেকে আমরা সবাই সচেতন হবো ঘরে যেন কেউ ঢুকতে না পারে। সামি মাকে
শুধরে দিয়ে বলল,' আমাদের ঘরে না। ফেসবুকের ঘরে গিয়ে প্রাইভেসি সেটিং এ
লেখা সব নিরাপত্তমূলক ব্যবস্হা সম্পর্কে জানতে হবে। শুধু কী ফেসবুক? অন
লাইনে এ ধরনের আরও ঘরবাড়ি আছে। এক কথায় এদের বলে সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যম। তেমন ধরো, ভাইবার, ইনস্টাগ্রাম, ইমু, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি
ইত্যাদি। তাই শুধু ফেসবুক না, বরং সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার
করার আগে প্রথমে নিজেকে নিরাপদ রাখার নিয়ম-কানুন জানতে হবে। টুম্পার মা
সব কথা শেষে শুধু বললেন, ' সামি তোর এত নলেজ পেটের মধ্যে নিয়ে বসে থাকলে
চলবে না। বরং চল, কলেজের প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা
বলি। তিনি এ বিষয়ে কলেজের মেয়েদের সচেতন করার জন্য ব্যবস্থা নিতে
পারবেন।' সামি বলল, 'গুড আইডিয়া। আমাদের সাথে টুম্পাকে
নিয়ে যাবো যাতে ও পুরো ঘটনা প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ও অন্যান্যদের জানাতে
পারে। এতক্ষণে মায়ের মুখের দুশ্চিন্তার রেখাগুলো মিলিয়ে গেল।
আজ রিংকির ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। রিংকির বাবা-মায়ের আজ বিশেষ
দিন। কয়েক দিন ধরেই তারা একটু আধটু উত্তেজিত। টেলিফোনে অথবা মোবাইলে
আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলার সময় রিংকি তাদের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর বুঝতে
পারে। তাদের এ উত্তেজনার কারণ রিংকি। রিংকি বাবা-মায়ের টেলিফোনিক
কথাবার্তা বেশ এনজয় করে। বেশিরভাগ কথাই রিংকিকে ঘিরে। মেয়ের পরীক্ষার
ফলাফল অতিমাত্রায় আশাব্যঞ্জক হবে - এটাই তো আদর্শ বাবা-মায়ের
প্রত্যাশা। ছোট বেলা থেকেই বাবা-মায়ের এই প্রত্যাশা পূরণ করে এসেছে
রিংকি। কখনো পরীক্ষার ফলাফলে তার পজিশন দুইয়ের ঘরে যায়নি। ক্লাসে শুধু
প্রথম হওয়াই নয়। বরং দ্বিতীয় পজিশনের জেসমিন, আফরোজা কিংবা মাহজাবীনের
চেয়ে টোটাল নম্বর অনেক বেশি নিয়ে এগিয়ে থাকে রিংকি। ছোটবেলা থেকেই
লেখাপড়ায় রিংকি অদ্বিতীয়। এজন্য আত্মীয়স্বজন ও বাবা-মায়ের চোখের মণি
রিংকি। স্কুলের হেড টিচার থেকে সব টিচাররা রিংকির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
শুধু পড়ালেখাই নয়, গান, উপস্হিত বক্তৃতা, অভিনয়, খেলাধূলা - সবকিছুতেই
সেরা রিংকি। সে এবার ক্লাশ এইটে উঠবে। বড় ক্লাশে প্রমোশন পাওয়া অর্থ
আরও বেশি বেশি পড়াশোনা। এ জন্য বাবা মা দিন দিন রিংকির দিকে আরও মনোযোগী
হয়ে উঠছেন। সব বিষয়ে তাদের সতর্ক দৃষ্টি। ক্লাস সিক্স থেকেই বাবা
মায়ের এত নজরদারি রিংকির কাছে ভীষণ অস্বস্তিকর। মাঝে মধ্যে রিংকির আচরণে
তা প্রকাশ পেয়ে যায়। রিংকির অস্বাভাবিক আচরণ বাবা মাকে ভীষণভাবে হতাশ
করে। তাই যত কঠিনই হোক রিংকি পরিবেশ হালকা করে নিতে দেরি করে না। কারণ
সে-ই-তো মা বাবার একমাত্র রাজকন্যা!
মা বাবার কাছে যেমন আদরের মেয়ে রিংকি, তেমনই মামা-খালা চাচা-চাচী সবাই
তাকে ভালবাসে আর ওকে নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখে। নেহাল মামা এর মধ্যে
সবচাইতে বড় স্বপ্নবাজ। তার স্বপ্নগুলোর অর্থ রিংকি ঠিক বুঝে উঠতে পারে
না। নেহাল মামা রিংকিকে প্রযুক্তিবিদ বানাতে চান। মামা বিশ্বের শীর্ষ
প্রযুক্তি কোম্পানির নামগুলো হাজার হাজার বার রিংকিকে শুনিয়েছে। মার্কিন
প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপল ব্র্যান্ড নেহাল মামার তালিকায় প্রথম। এর সাথে
রয়েছে গুগল, আমাজন, মাইক্রোসফট, স্যামসাং, ফেসবুক, ইন্টেল ইত্যাদি।
গতবার ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট শোনার সাথে সাথে নেহাল মামা আমেরিকা থেকে
ব্রান্ড নিউ আই ফোন পাঠিয়েছিলেন রিংকির জন্য। তখন ওর বয়সী কারো হাতে এ
ধরনের ডিভাইস থাকার কল্পনাও ছিল কল্পনা। বাবা-মা এ উপহার দেখে খুশির
চেয়ে সন্দেহে ছিলেন বেশি। এ স্মার্ট ফোনটি মেয়েকে ব্যবহার করতে দেবে
কিনা সে গবেষণায় বাবা মা কাটিয়ে দিল বেশ অনেক দিন। নেহাল মামার সাথেও
কথা বলে স্মার্টফোনের ভাল দিক মন্দ দিক নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। এ
সময়টা কী যে কষ্টের অনুভূতি নিয়ে সময় কাটিয়েছে রিংকি তা একমাত্র সে-ই
জানে! পরে অনেক চিন্তা ভাবনা শেষে সোনার হরিণ হাত পেয়েছিল রিংকি। এ
স্মার্টফোনটি তাকে পৃথিবীর ভালমন্দের জানালা খুলে দিয়েছে। বাবা-মায়ের
অগোচরে এ ফোনটিকে রিংকি ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে। প্রথম প্রথম ভিডিও দেখেই
বেশি সময় কেটেছে। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার থেকে
শুরু করে সারাদিন ফেসবুক, টিকটক ও ইউটিউব এর মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো
ব্যবহার করা যেন প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সাথে যোগ হয়েছে
নতুন নতুন বন্ধু-বান্ধব যাদের সাথে অনলাইনে প্রতিদিন অনেক সময় ধরে গল্প
করতে না পারলে মন অশান্ত হয়ে উঠতো। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, ঘুম নেই--
এই হয়ে গেল প্রতিদিনের নতুন রুটিন। মোবাইল গেমস ছিল আরেক নেশার জগত। সব
মিলিয়ে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ছিটেফোঁটা সময় পড়াশোনার জন্য বরাদ্দ রাখাও
দায় হয়ে পড়ে রিংকির। জীবনের এ আট নয় মাস কোথা থেকে কেটে গেল তা টেরই
পেল না রিংকি। তবে মাঝে মধ্যে মায়ের সন্দেহজনক দৃষ্টির সামনে নিজেকে
লুকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়তো। কোনরকম এড়িয়ে যাবার অভিনয় করেও একদিন
প্রায় ধরা পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। সেদিন গভীর রাতে নতুন বন্ধু
পিয়াস এর সাথে গল্প করায় এতই নিমগ্ন হয়ে গেল যে মা দরজায় টোকা না
দিয়ে ওর রুমে ঢুকে পড়েছেন তা খেয়ালই করেনি। পিয়াসের সাথে নিচুস্বরে
কথা বলায় মা কথাগুলো শুনতে পাননি। শুধু বললেন, ' এখন ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক
রাত হয়েছে।' মায়ের মুখটা বেশ মলিন ও দুঃখী দুঃখী লাগছিল। আর মাত্র দুই
দিন বাদেই পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। তখন মায়ের এ দুঃখী দুঃখী ভাবটা আর
থাকবে না। এ সব চিন্তা করে রিংকির রাত ভোর হয়ে গেল। পরীক্ষার রেজাল্টের
বিষয়টিও মাথার কোষে কোষে সারা রাত কুটকুট করে চলল।
সকাল বেলা ফুরফুরে মেজাজে বাবা মায়ের সাথে স্কুলের যাবার প্রস্তূতি নিতে
নিতে মা হালকাভাবে বলল, 'এবার নিশ্চয়ই তোর নেহাল মামা পরীক্ষার রেজাল্ট
শুনে কম্পিউটার গিফট করবে তাই না রে রিংকি?' রিংকি বলল,' হুম, দেখা যাক।'
এর ই মধ্যে স্কুলে পৌঁছে গেল সবাই। অভিভাবক ও ছাত্রীদের কোলাহলে স্কুল
প্রাঙ্গণ গমগম করছে। রিংকির রেজাল্ট ও অন্যান্য পারফরমেন্সের জন্য ওর
বাবা মা সবার কাছে বিশেষ মর্যাদা পান। সব টিচাররা ওদের অনেক ভালবাসে।
রিংকি খেয়াল করল মাহজাবীনকে আজ অনেক বেশি খুশি লাগছে। রেজাল্ট নিয়ে ওর
সাথেই সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা হয় রিংকির। রিংকিকে ছাড়িয়ে যেতে
চাইলেও কখনই সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি মাহজাবীনের। তাই আজ ওর খুশি দেখে হঠাৎ
এক অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে। হেড টিচারের ভরাট কণ্ঠে স্বাগত
বক্তব্য দিলেন। পিনপতন নীরবতায় ফলাফল জানার জন্য সবাই অপেক্ষা করতে
লাগল। 'এবার ক্লাস সেভেনে থেকে ক্লাস এইটে উত্তীর্ণদের ফলাফল ঘোষণা
করছি।' হেডটিচারের গলার এমন আওয়াজ বেশ চেনা রিংকির। প্রথম হয়েছে
মাহজাবিন খান সুরভী.... অভিনন্দন তোমাকে। সবাই অসম্ভব রকম নিঃশব্দ। রিংকি
খুব স্বাভাবিকভাবে শুনছে পরবর্তী নাম... দ্বিতীয় হয়েছে জেসমিন আক্তার
নাবিলা। তৃতীয় ফারজানা আক্তার বিউটি। এরপর কার নাম ঘোষণা হলো তা আর কান
পর্যন্ত পৌঁছাল না। শুধু কানে ভেসে এলো সপ্তম অবস্হানে আছে শারমীন চৌধুরী
রিংকি। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। রিংকির পাশে বসে থাকা তার মা
নিশ্চুপ, যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন শামীমা চৌধুরী, রিংকির মা । তার চোখের
সামনে ভেসে উঠল একটি ছবি! রিংকির হাতে নেহালের উপহারের স্মার্ট ফোন। কখনো
ফোনটি বদলে গিয়ে কুৎসিত জন্তূর রূপ নিচ্ছে। আবার কখনো রিংকিকে গ্রাস
করছে এই ফোন নামের কালো একটা পদার্থ! ফোনে বখাটে ছেলেদের সাথে ফিস ফিস
করে কথা বলছে তার আদরের মেয়ে শারমীন চৌধুরী রিংকি!
রিংকি বুঝল মা জ্ঞান হারাচ্ছে! এরপর ক্লাসরুমের নিস্তব্ধতা ভেঙে অসুস্থ
মাকে সবাই মিলে হাসপাতালে নেবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো!
রবিন আমার ভাইয়ের ছেলে। অতিমাত্রায় দুষ্ট এবং ফাজিল টাইপের। বয়স সতের
কী আঠার। রবিনকে কেউ তেমন পছন্দ করে না। আমি ঢাকা থাকি। প্রায়ই ভাইয়া
আমাকে রবিনকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার কথা জানান। আমি নিজে ছোটখাটো একটা
চাকরি করি। ভাইয়ার সমস্যার কথা শুধু শুনে যাই। কিন্তু তেমন কিছু করতে
পারি না। ভাইয়ার ফোন কল শুনলেই মনে হয় এই বুঝি রবিনকে নিয়ে আবার নতুন
কোন সমস্যা তৈরি হয়েছে। এভাবেই আমাদের দিনগুলো চলে যাচ্ছিল। সেদিন আমি
সব কাজকর্ম সেরে সবেমাত্র টেলিভিশনের চ্যানেল বাছাইয়ের যুদ্ধে ব্যস্ত,
ঠিক সে সময়ে ভাইয়ার ফোন! আমার মাথায় এক সাথে অনেকগুলো চিন্তা ও
দুশ্চিন্তার ঢেউ খেলে গেল। 'ভাইয়া, কেমন আছেন? কয়েক দিন ধরে আপনাদের
কোনো খবর নেই। সব ভালো তো?' আমি আগেই কথা বলার পরিবেশটা হালকা করার সুযোগ
করে নিলাম। 'না না নতুন কোন ইস্যু নেই। সব আগের মতোই চলছে। তোমরা কেমন?
'আমাদের চলছে কোনোরকম। করোনা বিদায় না হলে আর ভাল থাকা হবে না।' আমি
বললাম। 'ভাল থাকার জন্য নিজেদের চেষ্টা করতে হয়।' ভাইয়ার এ কথার অর্থ
কী। ভাল থাকা বা মন্দ থাকা এর জন্য আবার কেমন চেষ্টা দরকার। 'ধরো যদি সব
ভাই-বোনরা মিলিত হয়ে ছোটবেলার মতো কয়েকটা দিন একসাথে কাটাতে পারি, এটা
ভাল থাকার একটা চেষ্টা হতে পারে।' আমি ভাইয়ের মনের ভাষা পড়ে ফেললাম।
সত্যিইতো কতদিন আমরা ভাইবোনরা একসাথে হই না। আপনজনেরা একসাথে সময় কাটালে
মন ভালো হয়ে যায়। মনের স্বাস্হ্য ভাল থাকে। করোনার সময় মনের স্বাস্হ্য
নিয়ে অনেক আলোচনা শুনেছি। আগে মানুষ কখনো মনের অসুস্থতার কথা শোনেনি।
করোনা আমাদের মনেরও যে অসুখ হতে পারে তা টের পাইয়ে দিয়েছে। 'রবিন কেমন
আছে?' জানতে চাইলাম। ভাইয়া বিমর্ষ গলায় বলল, 'কোন পরিবর্তন নেই।য তবে
ইদানিং একটা দামি মোবাইল ব্যবহার করছে। এই মোবাইল কেনার টাকা কোথা থেকে
আসে জানি না।'
বেশি জানতে চাওয়া অপরাধ। খুব বিরক্তি প্রকাশ করে।' ভাইয়ার এ মনোবেদনা
দূর করার কোন কৌশল আমার জানা নেই। তবুও বললাম, ' যুগ পাল্টেছে, এ যুগের
ছেলে মেয়েরা আমাদের সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। এখন প্রযুক্তির যুগ। ছেলে
মেয়েদের নিয়ে বেশি ভাবনার দরকার কী?' ভাইয়া নিশ্চুপ, আমিও। আমাদের কথা
এভাবেই মাঝে মধ্যে গতিহীন হয়ে পড়ে।
এরপর অনেক দিন চলে গেছে। ভাইয়ার সাথে ফোনে নিয়মিত মামুলি কথাবার্তা
হয়। কিন্তু রবিন প্রসঙ্গ বেশি থাকে না। আমি ধরে নিয়েছি ভাইয়া এ
প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের লাইফস্টাইল সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা
পেয়েছেন। তবে একদিন আমাকে আফসোস করে বললেন, ' রবিনের দিনে ঘুমানো আর
সারারাত জেগে থাকার পক্ষে নিশ্চয়ই তোমার কোনো যুক্তি নেই।' আমি বললাম,
'কেন নেই ভাইয়া! আমাদের বড় চাচার ছেলে মুনতাসির কম্পিউটারে সারা রাত
কাজ করতো, তুমি দেখোনি?' ভাইয়া সাথে সাথে উত্তর দিলেন, ' আমি খেয়াল
করেছি মুনতাসিরের সাথে রবিনের খুব মিল। দূরত্ব যতই থাকুক ওদের যোগাযোগ
আছেই। আমি বুঝি না তারহীন এ যোগাযোগ কি করে সম্ভব।' 'ভাইয়া আপনি এখনো
সেকেলে রয়ে গেছেন! এখন ইন্টারনেটের যুগ। অনলাইনে সব সম্ভব। অনলাইন যুগে
আমেরিকাতো এখন দূরত্ব দিয়ে মাপযোগ্য কোন দেশ নয়।' এভাবেই আমাদের
কথাবার্তা নতুন নতুন শাখা প্রশাখায় প্রসারিত হতে থাকে। করোনার সময়ে
দেখাসাক্ষাৎ না থাকলেও যোগাযোগে কোনো ঘাটতি নেই।
কিন্তু এরই মধ্যে একটি দিন এলো যে দিনটির শুরু অন্য রকম। অন্য দিনের
চেয়ে দিনটি আলাদা। কারণ সকাল বেলা রবিনের ফোন! যাকে নিয়ে আমরা ভাইবোন
ফোনে এত কথা বলি সাত সকালে সেই রবিনের ফোন পেয়ে আমি যেন আকাশ দিয়ে
পড়লাম। 'ফুপি আমি আগামীকাল ঢাকা আসছি। জরুরি কাজে।' বাবাকে আমার সাথে
আসতে হবে। কিন্তু বাবা আসতে চাইছেন না। তুমি তাকে বুঝিয়ে বলো।' 'হঠাৎ কী
কারণে ঢাকা আসছো রবিন?' আমি বেশ কৌতুহলী হয়ে পড়লাম। 'এসে বলবো ফুপি!
এখন খুব ব্যস্ত। তোমার ব্যস্ততা কেমন? 'আমাকে উল্টো জিজ্ঞেস করল রবিন।'
ব্যস্ততার কথাতো আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না।' আমার সাদামাটা জবাবে
রবিনের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। 'আচ্ছা ফুপি বাবাকে ঢাকা যেতে
রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার ওপর দিলাম।' এর পরের ঘটনা বেশ তাড়াতাড়ি
এগিয়ে চলল। ভাইয়াকে অনেক অনুনয় বিনয় করে রবিনের সাথে ঢাকা আনার
দায়িত্ব ঠিকঠাক মতো পালন করলাম। কয়েকদিনের জন্য আমার নির্জীব ঘরটা
আনন্দে ভরে উঠল। ভাইয়াকে পেয়ে আমার মন চাঙ্গা হলো। তবে রবিন এখনো বলেনি
কি কারণে এত আয়োজন! আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ঢাকায় এসে
রবিনের ব্যস্ততা আমাদের রীতিমত অবাক করে দিচ্ছে। ওর নাগাল পাওয়া দায়
হয়ে পড়েছে। এক ফাঁকে শুধু বলে রাখলো, 'আগামী ২৬ তারিখ তুমি ও বাবা সকাল
ন'টায় তৈরি থাকবে। আমরা একসাথে একটি অনুষ্ঠানে যাব।'
কিন্তু অনুষ্ঠানে যাবার দিন আমরা দুই ভাই বোন একসাথে গেলাম। আমাদের সাথে
রবিনকে পাওয়া গেল না। আমরা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে হতবাক। বিশাল
অডিটোরিয়াম। অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত ঝাড়বাতি, বেলুন, ফেস্টুন ও বিভিন্ন
স্লোগানে সাজানো অনুষ্ঠানে আমরা হাজির হয়েছি। লাল গালিচা কার্পেটের পথ
দিয়ে একজন গাইড আমাদের নির্ধারিত স্থানে সসম্মানে বসিয়ে দিল। অনুষ্ঠান
শুরু হওয়ার মাত্র কিছু সময় বাকি। আমরা অতিথিরা অধীর আগ্রহে সামনে
সুসজ্জিত মঞ্চের প্রধান অতিথি এবং অন্যান্য অতিথিদের দেখছি। অনুষ্ঠান
উপস্থাপিকা বিশুদ্ধ বাংলায় সুরেলা কন্ঠে একের পর এক ঘোষণা দিয়ে
যাচ্ছেন। সব শেষে এলো পুরষ্কার বিতরণী পর্ব। আমরা অপেক্ষা করছি।
উপস্থাপিকা বলে চলেছেন 'এবার পুরস্কার গ্রহণ করতে আসবেন মফস্বল থেকে আগত
উদীয়মান ফ্রিল্যান্সার জনাব রবিউল ইসলাম রবিন, যিনি ডিজিটাল মার্কেট
থেকে সর্বোচ্চ আয়কারী একজন ফ্রিল্যান্সার। অভিনন্দন রবিউল ইসলাম রবিন
আপনাকে। এদেশের গৌরব আপনি। আমরা দেখছি পুরষ্কার গ্রহণের জন্য ধীর পায়ে
একজন এগিয়ে আসছে। সেই একজন আমাদের রবিন। স্টেজে রবিনকে বেশ স্মার্ট
দেখাচ্ছে। যেন আত্মনির্ভরশীল এক যুবক। উপস্থাপিকার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
'রবিউল ইসলাম রবিন, আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই আপনার অনুভূতি!
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আপনার অনুভূতি দর্শকদের জানাতে অনুরোধ করছি।' এবার
রবিন স্মিতহাস্যে বলতে শুরু করলো, 'যখন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজের
ক্যারিয়ার ডেভেলপ করতে গেলাম তখন পরিবার ও কাছের বন্ধুবান্ধব আমাকে ভুল
বুঝলো! আজ তাদের ভুল ভাঙানোর সুযোগ পেয়েছি। তাদেরকে আজ বলবো
ফ্রিল্যান্সিং একটি স্বাধীন পেশা। যে কেউ তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। এ পেশায় কোন বাউন্ডারি নেই।
পুরো পৃথিবীটাই একটি ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস। সেবা কেনার জন্য যেমন থাকবে
ক্রেতা, তেমনই থাকবে ফ্রিল্যান্সার, যারা সেবা দেবার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন
মুক্ত পেশাজীবী মানুষ। আমি গর্বিত এই ভেবে যে, একজন ফ্রিল্যান্সার হিসাবে
আমি দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারছি। অথচ এ চাকরির জন্য আমার
কোন নিজস্ব অফিসের প্রয়োজন নেই, কোন কর্মচারীর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন
শুধু প্রয়োজন একটি ল্যাপটপ ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ। ফ্রিল্যান্সার
হিসেবে এখন আমার আইডেন্টিটি আছে। হঠাৎ দর্শকসারি থেকে একজনের কণ্ঠস্বর
ভেসে এলো। দর্শকের কণ্ঠে সবাই শুনতে পেল, 'রবিন ভাইয়া আমি একজন
ডিজাইনার। আমার নাম সজীব। আমার কাজের অনেক প্রশংসা আছে। কিন্তু
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কিভাবে কাজ শুরু করব, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।
আপনি যদি আমাদের মতো যারা নতুন ফ্রিল্যান্সার হবে, তাদের জন্য কিছু
পরামর্শ দিতে পারেন, তাহলে আমরা বেশ উপকৃত হই। সজীবের প্রশ্ন শুনে রবিন
বেশ উৎফুল্ল হলো। সে বলল, তোমার মতো আমিও এক সময় অন্ধকারে হাতড়ে
বেড়িয়েছি। কিন্তু বন্ধু-বান্ধবের সাহায্য নিয়ে ফ্রিল্যান্সার
সংক্রান্ত অনেকগুলো লিংক ভিজিট করে সেল্ফ লার্নার হয়ে ফ্রিল্যান্সার
হওয়ার সব কৌশল জেনে নিয়েছি।' এ কথা শেষ করে রবিন একটি লিংকের নাম বলে
দিল। এছাড়া নিজে নিজে প্রশিক্ষিত হতে বিভিন্ন লিংকে সেল্ফ ট্রেনিং গ্রহণ
করে ফ্রিল্যান্সার হওয়ার সমস্ত বিষয় তোমরা জেনে নিতে পারো।
আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এ তো আমাদের সেই রবিন। ভাইয়া
নিঃশব্দে চোখের পানি মুছতে লাগলেন। মাতৃহীন এ ছেলেটিকে নিয়ে আজ তিনি
নিশ্চিন্ত। আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে শুধু বললাম, 'আমরা ডিজিটাল
বাংলাদেশে বাস করি। এখন শুধু চার দেয়ালের অফিসের কনসেপ্ট আর নয়। সারা
বিশ্বকে ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস ভাবুন।' ভাইয়া বললেন, 'আমাদের রবিনের রাতে
না ঘুমানোর রহস্য উন্মোচিত হলো। সারা বিশ্বের কাজে বাংলাদেশে রাত হয়ে
যায় দিন......।'
সাক্ষাৎকার দিতে ভিন্ন গ্রহ থেকে এসেছে তিনজন এলিয়েন। পৃথিবীর সবচেয়ে
মেধাবী ছেলে জুয়েল নাফিস পৃথিবীর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করছে।
আজ মহাশূন্যের স্যাটেলাইটে সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করা হবে একযোগে
এলিয়েনদের গ্রহ এবং পৃথিবীতে। সবাই সাক্ষাৎকার উপভোগ করতে পারবে তাদের
নিজ নিজ গ্রহ থেকে। জুয়েল নাফিস প্রথমেই তিনজনকে একই প্রশ্ন করল, 'তোমরা
কি মানুষ নাকি অন্য কোন প্রাণী যা মানুষ না।' আগুনের জ্বলন্ত পিন্ডের
গোলাকার আকৃতির এলিয়েন জবাব দিল, 'আমরা নিজেদের মানুষ বলি না।' নীলাভ
আলোর উল্টা মানুষের অর্থাৎ মাথা নিচে আর পা উপরের দিকে আকৃতির এলিয়েন
খুব চিন্তিতভাবে উল্টা প্রশ্ন করল,' মানুষ বলতে কি বুঝায়?' আমি কী
মানুষের মতো দেখতে?' এক চোখ ও এক মুখ আকৃতির সবুজাভ এলিয়েন বুঝে না বুঝে
বলল, আমরা না মানুষ, না প্রাণী, আমরা যন্ত্র। তাদের জবাব থেকে জুয়েল
নাফিস তার দ্বিতীয় প্রশ্নটি কি হবে তা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল।
তারপর এমন একটি প্রশ্ন করল যে প্রশ্নের উত্তর তিনজন এলিয়েনের পক্ষেই
দেওয়া খুব কঠিন হয়ে গেল। প্রশ্নের আগে সামান্য ভূমিকা ছিল, ' আমরা
মানুষ। আমরা পৃথিবীতে বাস করি। জুয়েলের প্রশ্নটি ছিল, 'মানুষের মধ্যে
এমন কিছু জিনিস আছে যা ধরা বা ছোঁয়া যায় না। স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ ইত্যাদি
কিছুই নেই। তোমরা কী এমন কিছু সম্পর্কে জ্ঞান রাখো?' তিনজন এলিয়েনই
জানতে চাইল, কী সে জিনিস যা তাদের মধ্যে নাই। কিন্তু মানুষের মধ্যে তা
আছে।' 'এর নাম ভালবাসা' জুয়েল জবাব দিল। ওরা বললো, 'একটু ব্যাখ্যা করে
বুঝিয়ে বললে ভালবাসা জিনিসটা সম্পর্কে জানতে পারতাম।' এলিয়েনরা ভালবাসা
কী তা জানতে চায়।
'সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা। এ ভালোবাসার উদাহরণ একমাত্র পৃথিবীতে
আছে। অন্য কোনো গ্রহে নেই।' 'ভালবাসা সম্পর্কে আরও কিছু বলবো। কিন্তু তার
আগে আমরা সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিতে পারি।' বলল জুয়েল। আগুনের পিন্ড
আকৃতির এলিয়েন বলল, 'আমার নাম ফুজাইম। আমি এমন এক গ্রহে বাস করি যে
গ্রহে আমরা সব সময় উত্তপ্ত থাকি। আমাদের সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। এই আছে,
এই নাই অবস্হা! আমাদের কোন আবেগ অনুভূতি নেই। তোমাদের পৃথিবী থেকে এই
গ্রহ হাজার হাজার মাইল আলোকবর্ষ দূরে।
এবার নীল রঙের মানুষের উল্টা আকৃতির এলিয়েন বলল, 'আমার নাম টিটে। আমি
পৃথিবীর মতো একটি গ্রহে বাস করি। পৃথিবী সম্পর্কে আমি অনেক আগে থেকেই
বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছি। তথ্য থেকে আমার মনে হয়েছে আমরা ঠিক পৃথিবী
গ্রহের বিপরীত স্বভাবের প্রাণী বা উল্টো মানুষ। অর্থাৎ পৃথিবীর মানুষ যা
করে আমরা তার উল্টোটা করি। দেখতেও আমরা উল্টা মানুষের মতো।'
এবার এক চোখ ও একমুখ আকৃতির সবুজ এলিয়েন রিপপা বলল, 'আমরা আসলে
যন্ত্রমানব। আমাদের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ হয় যন্ত্রের মাধ্যমে। যন্ত্রের
মাধ্যমে আমাদের ইচ্ছা পূরণ করি। আমাদের কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকে না। আমরা
যা চাই, তাই করতে পারি। তবে আমাদের 'ভালোবাসা' বলে কিছু নেই। আমাদের
গ্রহের উপরে একটি বিশাল আকৃতির ছাদ আছে। যেদিন আমরা ভালবাসার মতো একটি
অনুভূতি বা শক্তি অর্জন করতে পারবো, সেদিন আমরা ওই বিশাল ছাদ অতিক্রম করে
নতুন গ্রহে যেতে সক্ষম হবো। সেদিন আমরাও মানুষ হয়ে যাব। কেউ আড়াল থেকে
আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। আমরা যন্ত্র হয়ে বাঁচতে চাই না।
এবার নীলাভ টিটে জানতে চাইল, আমাদের এই সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য কী।
জুয়েল জবাব দিল, 'আমরা একে অন্যের ভাল গুণাবলী নিজ নিজ গ্রহের মানুষ বা
প্রাণী বা যন্ত্রমানবের মঙ্গলের জন্য শেয়ার করবো যাতে আমরা গ্রহ থেকে
গ্রহান্তরে ভালো থাকতে পারি।
সবুজাভ একমুখী আকৃতির এলিয়েন রিপপা বলল, 'আমরা সমস্যা নিয়ে কথা বলব,
যাতে সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারি।
নীলাভ উল্টা মানুষের আকৃতির টিটে বলল, আমাদের গ্রহের সমস্যা একটাই। আর তা
হলো গাছ অর্থাৎ বৃক্ষ। বৃক্ষ আর আমাদের মাঝে গভীর বন্ধন রয়েছে। আমাদের
যেকোন বিপদে বৃক্ষ এগিয়ে আসে। বৃক্ষ আমাদের কথা বোঝে। কিন্তু এতেও
আমাদের সমস্যা হয়।
এরপর এলো পৃথিবীর সমস্যা নিয়ে আলোচনা। জুয়েল নাফিস বলল, পৃথিবী আমাদের
মায়ের মতো। পৃথিবী আমাদের আলো, বাতাস ও পানির দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে।
পৃথিবীর সৌন্দর্য অতুলনীয়। মানুষের নিষ্ঠুর আচরণ এই পৃথিবীকে ধ্বংস করে
দিচ্ছে। মানুষের মধ্যে ভালোবাসা নামক অদৃশ্য শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
ইদানিং ভালোবাসা পরিবর্তে মানুষের মধ্যে লোভ, লালসা ও মোহের বাড়াবাড়ির
কারণে পৃথিবী নামক আমাদের এ সুন্দর গ্রহটি ধ্বংস হতে বসেছে। মানবজাতির
লেলিহান শিখার মতো প্রজ্বলিত লোভ-লালসা, মোহ ইত্যাদি কমিয়ে অসুস্হ
পৃথিবীকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। আর এই কাজে আমি পৃথিবীর মানুষ তোমাদের
সহযোগিতা আশা করছি। টিটে প্রশ্ন করল, লোভ, মোহ এসব কী করে পৃথিবী ধ্বংসের
কারণ হতে পারে? ফুজাইম ও রিপপারও একই প্রশ্ন। জুয়েলের অনেক কিছু বলার
আছে। জুয়েল ভাবছে কীভাবে অল্প কথায় মানবজাতির লোভ লালসা ও মোহের মতো
অনুভূতিগুলোকে ব্যাখ্যা করবে। তাই সে বেশ গুছিয়ে বলার চেষ্টা করল।
'বিষয়টি খুবই সহজ। তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো, তুমি তার যত্ন করবে, কোনো
ক্ষতি করবে না। কিন্তু আমরা পৃথিবীকে মায়ের মত ভালোবেসেও নিঃশব্দে
মায়ের ক্ষতি করে যাচ্ছি। ওরা অবাক হয়ে জুয়েলের কথা শুনছে। ধরো, গাছ
আমাদের ফল দেয়, খাবার দেয়, নিঃশ্বাস নেবার অক্সিজেন দেয়। কিন্তু আমরা
অকাতরে নিজেদের প্রয়োজনে গাছ কেটে ফেলি। গাছের জায়গায় আমরা অট্টালিকা
বানাই। গাছের কান্না আমরা শুনতে পাই না। নদী আমাদের মাছ দেয়, সুপেয়
পানি দেয়। নদী দিয়ে আমরা ভ্রমণ করি। কিন্তু নদীর পানি দূষিত করতে আমরা
নদীকে বানাই আবর্জনার স্তূপ। এই আবর্জনা খেয়ে মাছ মরে যায়। পানি দূষিত
হয়। বাতাস আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু কল কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের
কালো ধোঁয়া এবং গাড়ি চালিয়ে আমরা বাতাসকে করি সিসাযুক্ত। ভারী ও দূষিত
বাতাসে আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারি না। এসব কিছুই করি আমরা আরাম আয়েশে
থাকার জন্য। আমরা জীবনে যতই আরাম পাই, ততই বেশি
আরাম চাই। এটাই লোভ, এটাই মোহ। এগুলো দিন দিন বাড়ছে বলেই পৃথিবীর উপরে
আমাদের অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা ক্রমাগত বাড়ছে। তাই এমন একটা উপায় বের করা
চাই যেখানে মানুষও আরামে থাকবে আবার পৃথিবীও সতেজ থাকবে। সবাই মহা
ভাবনায় পড়ে গেল। পৃথিবীর এ কঠিন সমস্যা তো সমাধান করতেই হবে। 'কিন্তু
অদ্ভুত ব্যাপার হলো পৃথিবীর অনেক মানুষ আবার না খেয়ে থাকে, অনেকের থাকার
জায়গা নেই!' বলল রিপপা। 'তাদের ব্যাপারে তোমার কি বলার আছে জুয়েল' বলল
টিটে। 'যাদের বেশি আছে তারা যাদের নেই তাদের দেবে।' বলল জুয়েল। ফুজাইম
বলল,' অনেক বড় সমস্যা লুকিয়ে আছে এর ভিতরে।' জুয়েল সু্যোগ মতো বলল,'
তবে যারা না খেয়ে থাকে, যাদের থাকার জায়গা নেই, তারা পৃথিবীকে
ভালোবাসে। পৃথিবীর জন্য তাদের রয়েছে বুক ভরা ভালোবাসা।'
'সবার সমস্যার কথা শোনা হলো। চলো এবার সমাধানের দিকে যাই।' বলল, ফুজাইম।
প্রথমে আমরা পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে দ্রুত ব্যবস্হা নিতে
সবার মতামত জেনে নিতে পারি। ফুজাইম বলল, আমার উত্তাপ দিয়ে আমি কিছু
সময়ের জন্য মানুষের লোভ লালসা ও মোহ জাতীয় আবেগ অনুভূতি পুড়িয়ে ফেলতে
পারি। যন্ত্রমানব রিপপার প্রস্তাবও চমৎকার। আমি তোমাদের কিছু মানুষ যাদের
বুকভরা ভালোবাসা আছে, তাদের আমাদের গ্রহে নিয়ে যেতে পারি। ওদের কাছ থেকে
ভালবাসার শক্তি নিয়ে আমরা সেই বিশাল ছাদ অতিক্রম করে যন্ত্র মানব থেকে
মানুষে রূপান্তরিত হতে পারবো। টিটে চুপ করে সবার কথা শোনার পরে বলে উঠলো
তোমরা সব করে ফেললে আমি কী করবো? আমার কাছে পৃথিবীর সমস্যা সমাধানের ভাল
কিছু উপায় আছে। টিটের প্রস্তাব শোনার জন্য জুয়েলের আগ্রহ বেড়েই চলেছে।
টিটে বলল, আমাদের গ্রহের গাছগুলোর অনেক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। এক এক গাছের
এক এক ধরনের ক্ষমতা। যেমন ধরো, একটি গাছ হা করে অনেক কিছু গিলে ফেলতে
পারে। এরা আবর্জনা রাখার ডাসবিনের মতো কাজ করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে
আমাদের গ্রহে এখন আর কোনো আবর্জনা নেই। তাই ওদের অভুক্ত থাকতে হয়।
পৃথিবীর জলে স্হলে এসব গাছ লাগিয়ে দিলে আবর্জনার সমস্যা থাকবে না। বাতাস
বিশুদ্ধ করার জন্য পৃথিবীতে পাঠাতে পারি এমন গাছ যা অতি দ্রুত বাড়তে
থাকে। এদের নিঃশ্বাসে পৃথিবীর বাতাস বিশুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে এসব আশ্চর্য
গাছের বিনিময়ে আমরা পৃথিবীর কাছে চাই প্রযুক্তি। পৃথিবী প্রযুক্তিতে
অনেক এগিয়ে আছে। পৃথিবীর প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের উল্টা আকৃতি সোজা
করা সম্ভব। আমরা দেখতে পৃথিবীর মানুষের মতো সুন্দর হতে চাই। ফুজাইম বলল,
আমাদের উত্তাপ কমানোর কোন প্রযুক্তি থাকলে পৃথিবীর কাছ থেকে আমরাও
সাহায্য নিতে পারি।
জুয়েল নাফিস নিজেকে বেশ গর্বিত মনে করছে। এত দূরের গ্রহে বসবাস করেও
এলিয়েনরা পৃথিবীর প্রযুক্তি সম্পর্কে জানে- এ বিষয়টি ভাবতেই জুয়েল বেশ
আনন্দ পাচ্ছে। জুয়েল গদগদ গলায় বলল, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আজ প্রযুক্তির
শিখরে পৌঁছে গেছে। পৃথিবী প্রযুক্তির মাধ্যমে আজ তোমাদের সবাইকে এখানে
একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছে। তাই পৃথিবীর মানুষ প্রযুক্তির মাধ্যমে উল্টা
আকৃতির টিটেদের সাহায্য করবে। রিপপাদের গ্রহের তাপ কমাতে পৃথিবী নতুন
প্রযুক্তি আবিষ্কার করবে। আর বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে পৃথিবীর মানুষ
যন্ত্রমানবকে মানুষে রূপান্তরিত করবে। জুয়েল নাফিসের এসব কথা ম্যাজিকের
মতো সবাইকে অভিভূত করলো। এলিয়েনরা তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের কথা দিয়ে
আজকের মতো বিদায় জানাতে জুয়েলের দিকে এগিয়ে এলো। বিদায় পর্বে
ফুজাইমের অগ্নি উত্তাপ সহ্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আবার টিটের উল্টামুখী
পা দিয়ে গলায় সাপের মতো প্যাচ দেয়ায় জুয়েলের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার
পালা। ওদিকে যন্ত্রমানবের যান্ত্রিক হাতের মুঠোয় জুয়েলের হাতের নরম
হাড় মটমট করে শব্দ করছে। জুয়েল চিৎকার করে বিদায় বলছে। কিন্তু কেউ ওর
কথা শুনছে না। এ কী বিভৎস বিদায় পর্ব! জুয়েল উপায় না পেয়ে চিৎকার করে
বলছে, প্রযুক্তি নিতে হলে.......। জুয়েল চোখ খুলে দেখলো রুমমেট আবীর আর
পলাশ ওর হাত ধরে ভীষণ জোরে টানাটানি করছে। দূরে চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে
সিনিয়র ভাই রাশেদ রহমান, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। জুয়েল লজ্জা পেয়ে বলল,
এলিয়েনদের নিয়ে আজগুবি এক সাক্ষাৎকারের স্বপ্ন দেখছিলাম! প্রযুক্তি বলে
চিৎকার দেয়ার কারণ উদঘাটনে জুয়েলকে রুমমেটরা সবাই ঘিরে ধরলো।
অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ক্লাসের মধ্যে শুরু হয়েছে তুমুল বাকবিতন্ডা।
সামান্য ব্যাপারে ফিনা নামের মেয়েটি জারাকে যাচ্ছেতাই বলে গালাগালি
করছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। গালাগালিও হচ্ছে ইংলিশে। জারার সাথে যোগ
দিয়েছে জয়া আর মৌমি। আর ওদিকে ফিনার দল ভারী করেছে তিশা, নিমু মিতু।
রাহা, তানিয়া, বিশাখা রেবা এবং অন্যান্য মেয়েরা নিরপেক্ষ। একটু দূরে
দাঁড়িয়ে ঝগড়া এনজয় করছে। মাঝে মাঝে ওরা অবশ্য দুই পক্ষকেই
উস্কানিমূলক কথা বলে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। একপর্যায়ে জারাকে
হুমকি দিয়ে ফিনা বলল, 'তোমাকে দেখে নেব।' জারা সাথে সাথে জবাব দিল,
'তুমি যা খুশি তাই করো, আমার কিছু আসে যায় না।' সেদিনের মতো ঝগড়া শেষ।
যে যার মতো ভদ্রবেশে বাসায় চলে গেছে। ভাবখানা এমন যেন কিছু হয়নি। তবে
দুই দলই মনে মনে ফোঁস ফোঁস করছিল আর প্ল্যান করছে কিভাবে একে অন্যকে
ঘায়েল করবে। পরাজিত করবে। এ ঘটনার পর একটা সপ্তাহ নির্বিঘ্নে কেটে গেল।
কারণ সপ্তাহটায় অনেকগুলো পরীক্ষা থাকায় সবাই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত
ছিল। পরীক্ষা শেষ। সবাই ক্লাসে হাসিখুশি মুডে হাজির।
হঠাৎ জারার সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মৌমি ও জয়া আক্রমন করে বসল জারাকে।
জারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে যাচ্ছেতাই ভাষায় হুমকি দিতে লাগলো মৌমি ও
জয়া। মৌমি একটানা বলে যাচ্ছে, 'জারা, সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে আমাকে আর
জয়াকে নিয়ে এত বাজে কথা লিখে তুমি পোস্ট দিয়েছো যে আমরা কাউকে মুখ
দেখাতে পারছি না।' সেদিন তোমার পক্ষ হয়ে ফিনা আর তিশাকে কত কথা বলেছি!
অথচ আজ তোমার একটা মিথ্যা পোস্টের জন্য আমি সবার চোখে একটা খারাপ মেয়ে
হয়ে গেলাম! এক সাথে এতগুলো কথা বলে মৌমি ভেউ ভেউ করে কান্না শুরু করে
দিল। জয়াও একই অভিযোগের তীর ছুঁড়ে দিল জারাকে। এই সুযোগে ফিনা, নিমু ও
মিতু গিয়ে দাঁড়াল মৌমি আর জয়ার পাশে। ওরা বেশ ভালো এক সুযোগ পেয়ে গেল
জয়া আর মৌমিকে ওদের দলে টেনে নেবার। ফিনা বলতে লাগল, ' দেখো আমরা আগেই
তোমাদের বলেছিলাম জারা ভীষণ স্বার্থপর। ও যে কোনো সময় চেহারা পাল্টে
ফেলতে পারে। কাজেই ওর সাথে বন্ধুত্ব নয়, বরং আমাদের বন্ধু হও।' জয়া
সাথে সাথে জবাব দিল, ' আজ থেকে আমরা জারা নামের কাউকে চিনি না।' জারা
শুধু বার বার বলতে চেষ্টা করল সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে নির্দোষ।
কিন্তু ওর কথা কেউ শুনলোই না। অন্যান্য মেয়েরা কৌতুহলী হয়ে ঘটনা কী,
ঘটনা কী প্রশ্ন করতে লাগল। ঠিক এ সময় টিচার ক্লাসে এসে গেলে সেদিনের
ঘটনার সমাপ্তি ঘটল। তবে সারা রাত জারার ঘুম হলো না।
পরের দিন জারার উপরে চড়াও হলো ক্লাসের আরো কিছু মেয়ে। তারা জারাকে
অকথ্য ভাষায় বকাবকি করতে লাগলো। নূরী নামের শান্তশিষ্ট মেয়েটির এমন
ভয়ানক রূপ জারা আগে কখনো দেখেনি। নুরী বলতে লাগলো, 'তোমার ফেসবুক
একাউন্ট থেকে আমাকে তুমি যে সব মিথ্যে কথা লিখেছ সে জন্য তোমার শাস্তি
পাওয়া উচিত। আমরা তোমার কি ক্ষতি করেছি জারা? আমাদেরকে নোংরা ভাষায়
মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছো, তোমার এই পোস্ট আমাদের বন্ধু-বান্ধব, বাবা মা
আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে চলে গেছে। সবাই এ নিয়ে আমাদের অনেক সন্দেহ
করছে। আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব। তোমার এই
স্কুলে পড়া বন্ধ হবে।' জারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ভেবে পাচ্ছে না এ ধরনের
মিথ্যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে কেন করা হচ্ছে। আশ্চর্য হলেও সত্যি কেউ তার
কথা শুনতে চাচ্ছে না। জারা মনে মনে ভীষণভাবে ভয় পাচ্ছে স্কুল
কর্তৃপক্ষের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে বাবা-মা তাকে মেরেই ফেলবে! এসব
চিন্তায় জারার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। রাতে খাবার টেবিলে মা
জিজ্ঞেস করল, 'জারা তোমার শরীর কি খারাপ? খাচ্ছো না কেন? জারা কোনরকম
নিজেকে আড়াল করে খাবার রুম থেকে বেরিয়ে এলো। রাতে মনের দুঃখে একা একা
কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেলল জারা। ওর প্রিয় বন্ধুরা সব ওকে ছেড়ে যাচ্ছে।
কেউ ওর পাশে নেই। ওর কথা শোনার ধৈর্য কারো নেই। এই একাকিত্ব নিয়ে জারা
কি করে পড়াশোনা করবে, কী করে স্কুলে যাবে। মনে মনে ঠিক করে আগামী দিন
স্কুলেই যাবে না জারা।
স্কুলে না গেলে বাবা-মায়ের শত শত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। বাবা-মাকে
কোনোভাবেই সত্য কথা বলা যাবে না। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুম ভাঙ্গে
জারার। মাকে 'শরীর ভালো নেই '-এই ছোট কথাটি বলতেই মা কেমন ব্যতিব্যস্ত
হয়ে উঠলো। মাকে বলা গেল না শরীরের চেয়ে মনটাই তার বেশি খারাপ। মন খারাপ
করার বিষয়টি এখনো মায়েরা তেমনভাবে বোঝে না। তাই শরীর খারাপ বলাই বেশি
নিরাপদ মনে হলো জারার কাছে।
সারাদিন বন্দী হয়ে একা রুমে কাটানোর কষ্টে জারার মন খারাপ। স্কুলে সব
বান্ধবীরা কত মজা করে পড়াশোনা করছে, টিফিন ব্রেকে সবাই মিলে খাওয়ার
সময়গুলো ভীষণভাবে মিস করবে জারা। বিশেষ করে বাংলা ক্লাসটা মিস করা যেন
কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। বাংলা ক্লাসের মিস পল্লবী ম্যামকে জারার সবচেয়ে
বেশি পছন্দ। তিনি এত কোমল যেন গোলাপ ফুলের পাপড়ির মতো। সুন্দর কবিতা
আবৃত্তি করেন। কখনোই রাগ করেন না। জারাকে ভালবাসে এই ম্যাম। ম্যামের
ক্লাস মিস করা জারার জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি! কিন্তু স্কুলে যাওয়ার কথা
মনে হলেই জারার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের ভয়ঙ্কর
চেহারা। সবাই জারাকে ছেড়ে গেছে। ভাবতেই বুকের ভিতরে হু হু করে কান্না
আসে। জারা মনকে শক্ত করে ল্যাপটপ খুলে বসে। মনে মনে ভাবে ল্যাপটপে
ফেসবুকে ওদের সাথে একটা বোঝাপড়া হতে পারে। বেশ খুশি মনে ল্যাপটপ খুলে
নিজের ফেসবুক একাউন্টে চোখ রাখে জারা। কিন্তু এ কী....! জারার চক্ষু
বিস্ফারিত হয়ে গেল। ফেসবুকে জারাকে নিয়ে অনেক পোস্ট! শত শত পোস্ট।
পোস্টগুলো দেখতে গিয়ে জারার প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার
অবস্থা হয়। বান্ধবীরা তাকে নিয়ে যতসব কুৎসিত ও নোংরা সব মন্তব্য করেছে।
এর মধ্যে অনেকগুলো পঠন অযোগ্য। জয়া ও মৌমি ওরাও আছে। কেউ কেউ জারার ছবি
বিকৃত করে এঁকেছে। ছবি নিচে ছড়া লিখেছে ,অনেক কষ্টে একটি ছড়া জারা
পড়লো:
বোকা মেয়ে জারা,
স্কুল থেকে তাড়া।
জারা একটা ফাঁকিবাজ,
তার নাই কোন লাজ।
একজন জারাকে পাগল সাজিয়েছে। জারার মাথার চুল সব কাকের বাসার মত এলোমেলো।
পরনে শতছিন্ন কাপড়। পায়ে জুতা নেই। স্কুল ব্যাগ দূরে ছুড়ে ফেলে রাখা
হয়েছে। কেউ ছবির নিচে বড় অক্ষরে লিখে রেখেছে পাগল জারা। অনেককে জারা
চিনতে পারছে না। জারার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। কপাল দিয়ে টপটপ করে ঘাম
ঝরছে। হার্ট বিটের শব্দ শুনতে পাচ্ছে নিজের কানে। এ অবস্থায় হঠাৎ চোখে
পড়ল ফিনা গ্রুপের একটি পোস্ট। ওরা লিখেছে, 'বোকামীর দন্ড!' জারা ওদের
পোস্টের দিকে তাকিয়ে ভাবছে এ সবের অর্থ কী। তবে কী আমার পিছনে কেউ
ষড়যন্ত্র করছে? জারা আর ভাবতে পারছে না। এ অবস্থায় আগামীকালও স্কুলে না
যাবার সিদ্ধান্ত নেয় জারা। মাথা ঠান্ডা করে বিষয়টি ভাবার জন্য সময়
নেবে জারা। এভাবে আরও তিন চার দিন কেটে গেল। জারা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে
দিয়েছে। বাবা-মা অস্হির জারাকে নিয়ে। কিন্তু তারা কোনো ক্লু খুঁজে
পাচ্ছে না। জারা দিন দিন অসুস্থ হতে থাকলো।
অসুস্থ অবস্থায় একদিন সকালে জারার পল্লবী ম্যামের কথা মনে পড়ল। ভাবল
স্কুলে গিয়ে পল্লবী ম্যামকে সব কথা খুলে বলবে। যদি কোন সমাধান হয়।
অনেকদিন পর জারা ব্যাগ গুছিয়ে স্কুলে গেল। স্কুলের দারোয়ান জারাকে দেখে
বলল,' আপুমণি তুমি কি অসুস্থ? জারা বলল, 'না। আমি অসুস্থ না।' এরপর ক্লাস
রুমে যেতে যেতে যাদের সাথে দেখা হলো সবাই যেন ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে।
ক্লাসরুমে বান্ধবীরা সব আগের মতোই আছে। ওকে দেখে অনেকেই মুখ ঘুরিয়ে নিল।
কথা বলল না। জারা এর কারণ বুঝতে পারছে। কিন্তু ওর বিরুদ্ধে এই অপকর্ম
যারা করছে তাদের মুখোশ উন্মোচনের কোন কৌশল জারার জানা নেই। সবচেয়ে বড়
সমস্যা ওর কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সবার ধারণা অন্যায় করে আবার ন্যাকামি
করা হচ্ছে! জারা ধৈর্য্যসহকারে বাংলা ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো।
পল্লবী ম্যাম ক্লাসে ঢুকেই জারার দিকে তাকাল। তার মুখটা হঠাৎ কঠিন হয়ে
গেল। জারার মনে হলো ম্যাম সব ঘটনা জানেন। তিনি বললেন, 'এত দিন তুমি
স্কুলে আসোনি কেন? ক্লাস শেষ হলে আমার সাথে দেখা করবে।' জারা এটাই আশা
করছিল। ম্যামকে সব খুলে বলার সুযোগ পেয়ে জারা বেশ খুশি। ক্লাস শেষ
হওয়ার পর ম্যামের রুমে উপস্থিত জারা। ম্যাম কেমন যেন কঠোর চোখে ওর দিকে
তাকিয়ে বলল, তুমি টিচারদের সম্পর্কে এত সব বাজে কথা লিখেছ কেন? আমাকে
লিখেছ, ' পচা টিচার' এরকম করার কারণ কি?' সেই মুহূর্তে জারা কান্নায়
ভেঙে পড়ল। আমি এসবের কিছুই জানি না ম্যাম। আমি কখনো ফেসবুকে কোন কমেন্টস
লিখিনি। আমার নামে কেউ এসব লিখে চলেছে। কিন্তু আমি প্রমাণ করতে পারছিনা
ম্যাম। ম্যাম কিছুটা বোঝার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জারার বিরুদ্ধে অভিযোগের
পাল্লা এত ভারি যে তিনি শুধু বললেন তোমার এসব কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
তাছাড়া ইস্কুল থেকেও তোমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তবুও দেখি তোমার কথাগুলো কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে পারি কিনা। তুমি বাড়ি যাও।
জারার কাছে শেষ আশ্রয়স্থলটুকু যেন তেমন শক্তিশালী মনে হলো না। জারা
দুচোখে অন্ধকার দেখছে। বাসায় গিয়ে কী করবে তা ভাবতে ভাবতে হাঁটতে শুরু
করলো। একবার মনে হলো বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে গেছে। স্কুলের
সবাই বিষয়টি জেনে গেছে। বন্ধু-বান্ধব কেউ তার সাথে নেই। পল্লবী ম্যাম
তেমন কিছু করতে পারবে না। স্কুল থেকে নাম কেটে দিলে ঢাকার অন্য কোনো
স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ নেই। বাবা-মা জারাকেই দায়ী করবে। এর চেয়ে মরে
যাওয়াই ভাল। বড় রাস্তার মাথায় একটি চলন্ত গাড়ির সামনে ঝাঁপ দিল জারা।
এরপর ওর নিথর দেহটা পড়ে চৌরাস্তা মাথায়। সবাই দেখল জারা নামের মেয়েটি
আত্মহত্যা করেছে।
এরপর এক মাস চলে গেছে.......। জারার জন্য স্কুলের মেয়েদের শোক কাটেনি।
মেয়েদের যে কোনো আলোচনায় জারার প্রসঙ্গ আপনাআপনি চলে আসে। তবে সবচেয়ে
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে জারার ক্লাসের সবাই এক হয়ে গেছে। কোনো দল নেই।
সব এখন একদল। কোনো ঝগড়া-বিবাদ নেই। সবাই একসাথে জারার জন্য দুঃখ প্রকাশ
করে। একদিন সবাই একসাথে বসে ছিল তখন জয়াই কথাটা তুলল, ' আমরা যদি সবাই
মিলে বুলিং না করতাম......শান্তা সাথে সাথে প্রশ্ন করলো,' বুলিং কী জয়া!
আমার কোন স্মার্টফোন নেই, ফেসবুক নেই, আমি ঠিক বুঝিনা। তিশা জবাব দিল
শান্তার প্রশ্নের। 'বুলিং ইন্টারনেটের ভাষা। ফেসবুকের পাতায় তোমরা
জারাকে বিভিন্নভাবে বিদ্রুপ করেছো, নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছিলে, বিভিন্ন
অঙ্গভঙ্গিতে জারার ছবি তুলে মর্যাদাহানি করেছো, তাকে পাগল বানিয়ে কবিতা
লিখেছো। এভাবে কাউকে অনলাইনে আক্রমণ করাই হলো বুলিং। বিশাখা এর সাথে যোগ
দিয়ে বলল, 'তোমার স্মার্ট ফোন না থেকে ভালই হয়েছে। থাকলে হয়তো এ ভুলটা
তুমিও করতে। ফেসবুকে বুলিং করে আমরাই তো ওকে মেরে ফেললাম।' তিসা আর চুপ
করে থাকতে পারলো না। 'ইন্টারনেট জগত একটা অলীক জগত। এটা যেন সোনার হরিণ।
সবসময়ই মনে হয় এর পিছনে ছুটে চলি। কিন্তু এই সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে
গেলে কিছু কৌশল আয়ত্ত করতে হয়। সেই কৌশলগুলি ব্যবহার করে তুমি এ জগত
থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। আর যদি কৌশল ব্যবহারে ব্যর্থ হও
তাহলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে নিয়ে আসবে।'তিসা গরগর করে কথাগুলো বলে
জারার প্রতি ওর প্রগাঢ় ভালোবাসা প্রকাশ করলো। ফিনা আগের থেকে অনেক
চুপচাপ হয়ে গেছে। জারার মৃত্যুতে ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। সবার
কথা শুনতে শুনতে একসময় ফিনা হু হু করে কেঁদে ওঠলো। কাঁদতে কাঁদতেই বলতে
লাগলো, 'আমি সবকিছুর জন্য দায়ী। সেদিন ওদের সাথে ঝগড়ার পরে প্রতিশোধ
নিতেই আমি ফেসবুক ব্যবহার করে এসব জঘন্য কাজ করেছি। জারার একাউন্ট হ্যাক
করে আমি ওর ছদ্মবেশে ওর প্রিয় মানুষগুলোকে খেপিয়ে তুলেছি। এজন্যই তো
পল্লবী ম্যাম জারাকে বকাবকি করে বের করে দিয়েছেন। সেদিন আমি কত যে
আনন্দে ছিলাম! কিন্তু একবারও ভাবিনি জারার কষ্টের কথা। 'হ্যাক আবার কি
জিনিস? শান্তা এ সময়েও প্রশ্ন করেই চলেছে। মৌমি ওর দিকে কটমট করে
তাকালো। কিন্তু ফিনা কান্না থামিয়ে বলল, ' আসলে আমাদের জানা দরকার। তা
না হলে আমরা আবারও কোনো ভুল করবো। আমরা আর কখনো এমন ভুল করতে চাই না।'
তুমি যখন চুরি করে অর্থাৎ অবৈধভাবে অন্যের ফেসবুক একাউন্ট ব্যবহার করো
তখন তুমিই হ্যাকার।' শান্তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন পল্লবী ম্যাম।
তিনি কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনছিল তা কেউ টের পায় নি। আমাকে
'পচা টিচার' বানিয়েছিল তোমাদের মধ্য থেকেই একজন হ্যাকার। আমরা সেটা
তদন্ত করে বের করেছি। সবাই জানতে চাইল 'কে সেই হ্যাকার?' 'ফিনা' ছদ্মবেশে
নকল জারা সেজে ফিনা আসল জারাকে সবার কাছে অপ্রিয় করে তুলেছে। জারা সেই
অপমান সহ্য করতে পারেনি। ফিনার মুখোশ খুলে দিলেন ম্যাম। ফিনা অপরাধীর মতো
বসে রইল। ফিনা না বুঝে এ অপরাধ করায় স্কুল থেকে ওর বিরুদ্ধে কোনো
ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তবে তোমরা কখনো আর এ ধরনের ভুল করো না। এবার
চলো, আমরা আজকের পড়া শেষ করি। সবাই দেখল ফিনা কেঁদেই চলেছে। ওর কান্নার
যেন আর শেষ নেই। ম্যাম দেখলেন, সব মেয়েরা ফিনাকে ঘিরে অনুতপ্ত হয়ে বসে
আছে। আজ আর পড়ায় কারো মন বসবে না - এ ভেবে পল্লবী ম্যাম ধীর পায়ে
ক্লাস রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
একটা ছোট্ট ছেলে, হুলহুলিয়া গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে বড় হয়ে
উঠেছিল। নাটোর জেলার সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামটি তখন কেইবা চিনতো! রজব
আলী তালুকদার হুলহুলিয়া গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি ১৯২৯ সালের ১লা
নভেম্বর প্রথম সন্তানের জনক হলেন। সেই ছোট্ট ছেলেটি রজব আলী তালুকদারের
প্রথম সন্তান। পরম আদরের প্রথম সন্তান। ছেলের নাম রাখলেন মোঃ হানিফউদ্দীন
মিয়া। এই ছোট্ট ছেলেটির কারণে হুলহুলিয়া গ্রামটি এখন সবার অতিপরিচিত
একটি গ্রাম। অতিসাধারণ গ্রামটি হয়ে উঠল একটি বিখ্যাত গ্রাম। হুলহুলিয়া
গ্রামের বিখ্যাত হয়ে ওঠার গল্পটি বাংলাদেশের মানুষের জানা প্রয়োজন।
এ গ্রামের শ্যামল ছায়ায় বেড়ে ওঠা সেই ছেলেটির কৈশোরের দূরন্তপনা কিংবা
বিশেষ কোনো ঘটনার কথা তেমনভাবে জানা যায় না। লাজুক, মিষ্টভাষী ও লম্বা
ছিপছিপে গড়নের সেই ছোট্ট ছেলেটি অন্য পাঁচজন ছেলেরা মতোই হুলহুলিয়া
গ্রামের মাটিতে হেসেখেলে বড় হয়ে উঠছিল।
বাবার সংসারে ছিল না কোনো অভাব। তিন সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বাবা
রজব আলী তালুকদার স্বাচ্ছন্দে বহন করে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতেন। কিন্তু
পড়াশোনার জন্য তখন নিজ বাড়িতে থাকার সুযোগ ছিল না। তখনকার দিনে অন্যের
বাড়িতে 'জায়গীর' থেকে পড়াশোনা করার ব্যবস্হা ছিল। হানিফ মিয়াও নিজের
বাবা-মাকে ছেড়ে পড়াশোনার জন্য দূরে অন্যের বাড়িতে জায়গীর থাকতো।
এভাবে এক পর্যায়ে জায়গীর থাকার পর্ব শেষ হলো। বড় বড় ডিগ্রি অর্জনের
জন্য হানিফ মিয়া আর দেশে বসে থাকতে পারে না। তাকে পাড়ি জমাতে হবে
উপমহাদেশের ভালো ভালো বিদ্যাপীঠে। দেশের সীমানা পেরিয়ে হানিফ মিয়া
পাড়ি জমালো ক্যালকাটা( বর্তমান কলিকাতা)। ১৯৪৬ সালে হানিফ মিয়া
ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে অর্জন করে ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট। ১৯৪৮
সালে হানিফ মিয়া কৃতিত্বের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে
আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫১ সালে বিএসসিতেও প্রথম বিভাগ লাভ
এবং ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএসসি পরীক্ষায় ফলিত গণিতে
প্রথম শ্রেণিতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম স্থান অর্জন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে
দেয় মোঃ হানিফউদ্দীন মিয়া। এরপর শুধু পড়াশোনা আর পড়াশোনা। দেশ বিদেশে
নানা বিষয়ে নানা পড়াশোনা। ভূরি ভূরি ডিগ্রি অর্জন। মানুষের মন জয় করা
একজন সেরা মানুষ হয়ে গেলেন হানিফ উদ্দীন। কিন্তু লেখাপড়ায় ভালো হলেই
কি মানুষ দেশপ্রেমিক হয়?
অসাধারণ জ্ঞান পিপাসু এই মানুষটি যে সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক সেই
কাহিনি যেন এক গল্প। এ গল্পের শুরু ১৯৬৪ সালে। তখন এ দেশ পরাধীন। এ দেশের
নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান শাসন করতো তৎকালীন পশ্চিম
পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান ছিল স্বর্গরাজ্য। পশ্চিম পাকিস্তানের
রাজধানী লাহোর ছিল চাকচিক্যে ভরপুর একটি শহর। তখন সবাই এই চাকচিক্যময়
শহরে ভ্রমণ করার স্বপ্ন দেখতো! কিন্তু এ স্বপ্ন পূরণের কোন সম্ভাবনা যে
নেই! এ রকম একটি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেই আলো
ঝলমলে শহরে এলো এক বিশাল উপহার। এ উপহার নিয়ে শুরু হলো জল্পনা কল্পনা। এ
উপহার দেখতে কেমন, এ উপহার কী কাজে লাগবে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজনের এ
উপহার দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ বলল এ কেমন উপহার!
ঢাউস আকৃতির কালো রঙের একটি বাক্স যা কিনা বিরাট জায়গা দখল করে বসে আছে।
এ বাক্স দিয়ে নাকি আবার অংক করা যায়! কেউ বাক্সটিকে বলে টেলিভিশন, আবার
কেউ এর নাম দিয়েছে কম্পিউটার। কিন্তু এই অদ্ভুত বাক্সটি চালানোর জন্য
উপযুক্ত কোনো কারিগর নেই। পশ্চিম পাকিস্তানে এই বাক্স চালানোর মত যোগ্য
ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া গেল না। তারা তন্ন তন্ন করে এই বাক্স চালানোর
কারিগর খুঁজেই চলল। কিন্তু বিফলে গেল তাদের সব প্রচেষ্টা। এই বাক্স
চালিয়ে কঠিন কঠিন অংক এক নিমিষে সমাধান করে দিতে পারে এমন কারিগর পাওয়া
যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপার!
তাই এই বাক্সটি পড়ে রইল পশ্চিম পাকিস্তানে। এরই মধ্যে একটা খবর সবার নজর
কাড়ল। এই কালো রংয়ের বাক্সটি চালানোর মতো মাত্র একজন মানুষ খুঁজে
পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই মানুষটির বাস পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা শহরে। তিনি
একমাত্র জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ যিনি এই কালো রংয়ের বাক্সটি ব্যবহার করতে
পারেন। তাঁর নাম মোঃ হানিফউদ্দীন মিয়া। এখন জনমনে হাজারো প্রশ্ন দেখা
দিল। হানিফ মিয়া কোথায় কম্পিউটার বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন? পরে যখন সবাই
জানালো কম্পিউটার বিষয়ে হানিফউদ্দিনের জ্ঞান অর্জনের কাহিনি, তখন মানুষ
অবাক হয়ে গেল। জানা গেল, ১৯৬০ সালে অ্যানালগ কম্পিউটার টেকনিক এবং
ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে মোঃ হানিফউদ্দীন ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন
থিওরি এন্ড অটোমেশন, চেকোস্লোভাক একাডেমি অব সায়েন্স, প্রাগ থেকে
প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। ১৯৬৪ সালে এমআইটি (যুক্তরাষ্ট্র) কম্পিউটার
সেন্টার থেকে সিস্টেম অ্যানালিসিস, নিউমেরাল ম্যাথমেটিকস, অ্যাডভান্স
কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, অপারেশন রিসার্চে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এ খবর
লাহোরে পৌঁছানোর সাথে সাথে কালো বাক্স অর্থাৎ কম্পিউটারটি চালানোর জন্য
মোঃ হানিফউদ্দিন মিয়াকে তলব করা হলো লাহোরে। লাহোরে যেতে হবে তাঁকে। যে
শহরে যাবার জন্য মানুষ স্বপ্ন দেখে। যেখানে গেলে জীবন ধন্য হয়ে যায়।
এমনই এক লোভনীয় প্রস্তাব হানিফউদ্দিনের কাছে এসে গেল! তখন কী করলেন
হানিফউদ্দিন! তিনি স্রেফ বেঁকে বসলেন। এই লোভনীয় প্রস্তাব তিনি
প্রত্যাখ্যান করলেন। দেশ ছেড়ে কোথায়ও যাবেন না তিনি। যতই সুযোগ দেয়া
হোক না কেন তিনি দেশেই থাকবেন। তাঁর এই একগুঁয়েমি দেখে সবাই হতাশ। এত
বড় সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? সুযোগ তো জীবনে বার বার আসে না। কিন্তু কে
শোনে কার কথা? তার কথার এক চুল নড়চড় করার সাধ্য কার? তিনি তো কম্পিউটার
বিশেষজ্ঞ। তার এ জ্ঞান অন্য কারো নেই। কাজেই উপহার হিসেবে পাওয়া
কম্পিউটারটি পরিচালনায় তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যাকে সবার প্রয়োজন। তখন
হানিফউদ্দিনের জেদ বহাল রইল। শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান ঢাউস আকৃতির
আইবিএম মেইনফ্রেম ১৬২০ বৃহদাকৃতির ওই কম্পিউটারটি
পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ঢাউস আকারের সেই কম্পিউটারটিকে
ঢাকার আণবিক শক্তি কমিশনে স্থাপন করা হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি
ডিজিটাল মেইনফ্রেম কম্পিউটার।
কম্পিউটারটি স্থাপন করতে দুটি বড় রুম ব্যবহার করতে হয়েছিল। হানিফউদ্দিনের
জন্য এদেশের মানুষ প্রথম কম্পিউটার দেখার সৌভাগ্য লাভ করে। তিনি সুখের
হাতছানি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বলেই সেই কম্পিউটারটি এদেশের স্থান লাভ
করেছিল। বর্তমানে প্রথম সেই কম্পিউটারটিকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
মোঃ হানিফউদ্দিন এদেশের গর্ব। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া প্রথম
কম্পিউটারটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আনবিক যে প্রস্তাবে রাজি হয়ে
যেতেন। তিনি এ দেশের মায়া ছেড়ে বিদেশে যেতে চাননি বলেই এদেশের মানুষ
কম্পিউটার দেখার সুযোগ পেয়েছে। তাঁর প্রচেষ্টায় এ দেশের
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ব্যবহার
করা সম্ভব হয়েছিল। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, মোঃ হানিফউদ্দিন মিয়া
একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। আমরা তাকে সম্মান জানাই। ২০০৭ সালের ১১ মার্চ
দেশপ্রেমিক এই মানুষটি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি
কম্পিউটার শিল্পের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
অনুকে দেখলেই মিতুর ভয় লাগে। অনু মিতুর বড় বোন। পাঁচ বছরের বড়। কিন্তু
ভাবখানা যেন পঞ্চাশ বছরের বড়। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। হাতে অবশ্য লাঠি
নেই। তবে একটি স্মার্ট ফোন কোমড়ের কাছে ছোট একটা কিউট ব্যাগে সব সময়
সঙ্গীর মত আছে। মিতু মনে মনে অনু'পাকে 'উপদেষ্টা' বলে ডাকে। তবে তনু আর
রানু আপা তা জানে না। শুধু জানে জিতু। জিতু সবার ছোট। জিতুর সাথে মিতু সব
শেয়ার করে। কিন্তু আজ অনু'পাকে (অনু আপা) কেমন যেন হাসিখুশি লাগছে। মিতু
চোখ কচলে ভালোমত দেখার চেষ্টা করলো। ঠিকই তো, নাকের ওপর কালো ফ্রেমের
চশমাটি নেই। আর তাতেই অনু'পার মুখখানি হাসিমাখা লাগছে। চশমা ছাড়া
অনু'পাকে উপদেষ্টার মতো লাগছে না! বাহ্ বেশ তো! মিতু দোতলার বারান্দা
থেকে এসব দেখছিল। জিতুকে দেখানোর জন্য মিতুর আর তর সইছে না। জিতুকে ডাকতে
গিয়ে মুখটা হা করলো। কিন্তু হা করা মুখটা আর বন্ধ করা হলো না মিতুর।
জিতুকেও ডাকা হলো না। বিস্মিত চোখে দেখলো অনু'পার সাথে নতুন কেউ গেট পার
হয়ে বাড়িতে ঢুকছে। মিতুদের মফস্বল শহরের এ বাড়িটা অনেকটাই সেকেলে
টাইপের। তবে বাড়িটা সেকেলে হলেও এ বাড়ির প্রতি পাঁচ বোন আর বাবা মায়ের
গভীর ভালবাসা জড়িয়ে আছে। অনু'পার সাথে যাকে দেখছে মিতু, তাকে আগে কখনো
দেখেনি। মিতু টের পেল কখন যেন জিতুও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দুজন বিষয়টা
বোঝার চেষ্টা করছে। আজ ওদের অংকের নতুন টিচার আসার কথা। তাহলে ইনিই কী
অংকের নতুন টিচার? দেখে তা মনে হচ্ছে না। দেখতে অনু'পার চাইতেও ছোটখাটো
একটি মেয়ে। চোখে চশমাও নেই। টিচার টিচার ভাবসাবও নেই। জিতু বলল- কে রে
মিতু? পিঠেপিঠি হবার কারণে জিতু মিতুকে আপু বলে না। মিতুও দুরত্ব কমিয়ে
দিতে ওর মিতু ডাকটা মেনে নিয়েছে। তবে অন্যদের বেলায় এসব একদম চলে না। এ
বিষয়ে পরিবারে বাবার চেয়ে মায়ের হুকুমই মেনে চলতে হয় সবাইকে।
নিচতলার বসার ঘরে অনু'পার সাথে নতুন মেহমানের পদার্পণ হলো। গেটের কাছে
লাইটপোস্টের ওপর বাবার হাতে পেরেক দিয়ে আটকানো পুরাতন মডেলের ঘড়ির দিকে
চোখ পড়ল জিতুর। ' মিতু আজ শনিবার , এখন বেলা ১১:৩০। তনু, রানু আপুদের
বাসায় ফেরার সময়। এর অর্থ হলো 'আমরা সবাই এখন বাসায়।' 'নিশ্চয়ই
অনু'পার কোন সুপ্ত প্ল্যান আছে।' জিতুর কথাগুলো শেষ হবার আগেই মিতু শুনতে
পেল তনু আর রানু আপার মিষ্টি হাসির শব্দ। গেটের ওপাশ থেকেই এমন হাসির
শব্দে মিতু জিতুর ভ্যাবাচ্যাগা অবস্হা। সবাই হাজির! এখন অপেক্ষা শুধু
পরবর্তী ইভেন্টের! মিতু জিতু এক সাথে সিঁড়ি দিকে দৌড়াতে লাগলো। বসার
ঘরের পর্দা সরিয়ে ওরা উঁকি দিল। কিন্তু ওদের দিকে কারো কোনো খেয়ালই
নেই। এর মধ্যে তনু রানু আপুরাও ওখানে হাজির। সবাই চুপচাপ হয়ে নিঃশব্দে
খুব মনোযোগসহকারে কিছু একটা দেখছে! কী দেখছে! মিতু জিতুর কৌতূহল ও আগ্রহ
লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলছে। কিন্তু সমস্যা হলো কেউ ওদের দিকে খেয়াল
করছে না। বড়দের অনুমতি ছাড়া ভিতরে ঢুকে পড়াটাও ঠিক হবে না। ঠিক এ
সময়ে ছোটখাটো মেয়েটি মাথা তুলে ওদের দেখতে পেয়ে একটা বিশ্ববিজয়ের
হাসি দিয়ে স্পষ্ট গলায় ওদের দুজনের নাম ধরে বলল 'মিতু জিতু তোমরা বাইরে
কেন? ভিতরে এসো। তোমাদের জন্য মজার জিনিস অপেক্ষা করছে।' অনু আপাও
এতক্ষণে তার কঠিন গলার স্বরটিকে কেমন কোমল করে আমাদের ডাকলেন 'আয় রে
জিতু মিতু এখানে এসে আমার পাশে বোস। তোদের জন্য সারপ্রাইজ আছে।' এ ডাকের
জন্যইতো অপেক্ষা করছিল ওরা।
নিয়ন বাতির মতো আলোময় একটা স্ক্রীনের দিকে ওদের চোখ আটকে গেল। স্ক্রিনে
কিছু ইংরেজি লেখা ভেসে আছে। সেসব লেখাগুলোর দিকেই সবার চোখ আটকে আছে।
ছোটখাটো মেয়েটি কী যেন খুটখুট শব্দ করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল আরেকটি লেখা
'বাংলাদেশ'। এবার মেয়েটি বলল, 'আমার নাম রেবেকা সুলতানা। আজকে মেয়েদের
কলেজে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে আমি একজন বিচারক ছিলাম।
আমি ঢাকা থেকে এসেছি। তোমাদের বড় বোন ফারিহা তাসনিম অনু'র বুদ্ধিমত্তা ও
বিজ্ঞানের প্রতি ওর অদম্য আগ্রহ আমাকে বিস্মিত করেছে। আজ বিজ্ঞান মেলায়
ওর প্রথম হওয়ার গৌরব আমাকে অভিভূত করেছে। ওর কাছেই তোমাদের গল্প শুনেছি।
পাঁচ বোনের গল্প শুনে তোমাদের দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাইতো চলে
এসেছি। তোমরা নিশ্চয়ই অনুর মতো অংক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মতো বিষয়গুলি
ভালোবাসো। তবে আমি কিন্তু নিজে বিজ্ঞান কিংবা অংকে খুব একটা ভালো না।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো আমি ভালোবাসি কম্পিউটার। কম্পিউটার ছাড়া আমার এক
দিনও চলে না। আর আজ বিজ্ঞান মেলায় প্রথম হওয়ায় পুরস্কার হিসেবে তোমার
বোন পেয়েছে এই ল্যাপটপটি'। তনু আপু হঠাৎ করে প্রশ্ন করে বসলো, 'আপনি
কম্পিউটারের বিশেষজ্ঞ হয়ে বিজ্ঞান মেলার বিচারক হলেন কেন?' প্রশ্ন শুনে
রেবেকা সুলতানা যেন আরও সতেজ হয়ে উঠলেন। মনে হলো এ প্রশ্নের উত্তর দেবার
জন্যই তিনি আজ এখানে। রেবেকার গলার স্বর খুব স্পষ্ট। প্রশ্নের উত্তর দিতে
গিয়ে স্বরটা যেন আরও একধাপ স্পষ্ট ও জোরালো হয়ে উঠলো। তিনি বলতে
লাগলেন, 'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মাসতুতো ভাই। বিজ্ঞান কোন কিছু আবিষ্কার
করার তত্ত্ব দেয় আর প্রযুক্তি সেই তত্ত্ব ব্যবহার করে যণ্ত্র বা উপকরণ
বানায়। তাই বিজ্ঞান ছাড়া প্রযুক্তি অচল আবার প্রযুক্তি দিয়ে উপকরণ বা
যণ্ত্র না বানালে আমাদের জীবনে এত আরাম আয়েশ সম্ভব হতো না। যেমন ধরো,
কম্পিউটার না থাকলে কেমন করে চোখের পলকে ই- মেইলে পাঠাতাম প্রিয়
মানুষদের? সারা পৃথিবীর যেকোনো ঐতিহাসিক স্হানের ভিডিও দেখা কী করে সম্ভব
হতো? সিসি ক্যামেরার সাহায্যে বাড়িওয়ালার চোর ধরার গল্পতো এখন ডালভাত!
জিতু চুপচাপ সব শুনছিল। সবার ছোট হিসেবে তার এ সব জটিল বিষয় নিয়ে
প্রশ্ন করার কথা না। কিন্তু জিতুর প্রশ্ন শুনে সবাই হতভম্ব! 'আচ্ছা
গুহাবাসীদের তো কম্পিউটার বা ল্যাপটপ কিছুই ছিল না। তারাও তো এই পৃথিবীর
মানুষ। হাজার হাজার বছর ধরে তারাও তো বাস করে আসছিল এই পৃথিবীতে। ওরা তো
অনেক কষ্টে ছিল, তাই না আপু?' গুহাবাসীদের দুঃখে জিতু মনে হয় এখন কেঁদেই
ফেলবে! রেবেকা আপুর গলায় যেন হঠাৎ মায়া মায়া ভাব এসে গেল। 'গুহাবাসীরা
কিন্তু আগুন আবিষ্কার করেছিল, চাষের জন্য লাঙ্গল আর বন্য পশু শিকারের
জন্য তীর ধনুক বানাতে শিখেছিল। মানুষ যে বুদ্ধিমান প্রাণী তা সেই
গুহাবাসী মানুষদের সাধাসিধে প্রযুক্তির ব্যবহার দেখেই আমরা বুঝতে পারি।
তা না হলে প্রকাণ্ড আকারের হিংস্র পশুদের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে
এবং প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে আজকের আধুনিক মানুষ রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব
ছিল না।' এ পর্যন্ত বলে জিতুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন রেবেকা সুলতানা। জিতু
তার ছোট্ট মাথাটা দুলিয়ে রেবেকা আপুর কথায় সায় দিল যেন! রেবেকা
সুলতানা একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। অনু আপাকে বেশ ভালভাবে দেখতে থাকলো মিতু।
মিতু ভেবে পায় না এত জ্ঞান আপু পেল কোথায়? বিজ্ঞান মেলায় প্রথম হয়ে
ল্যাপটপ পুরষ্কার পেয়ে গেল! সারাদিন তো আমাদের পড়াশোনার জন্যই আপু বেশি
তদারকি করে। তবে আপুর একটা বিষয় মিতুরও ভাল লাগে। কোন বিষয় না বুঝে
মুখস্থ করা আপু একদম পছন্দ করে না। আমাদেরও সব সময় অন্ধের মতো পড়া
মুখস্থ করতে দেখলে আপু সেটা ধরে ফেলে। এ জন্যই আজ তার এই সাফল্য! মিতুর
ভাবনায় ছেদ পড়ল নতুন আপুর কঠিন প্রশ্নে। 'তোমরা কী জানো বাংলাদেশের
প্রথম কম্পিউটারের গল্প?' এবার রানু আপুর কৌতুহলী চোখের দিকে আমার দৃষ্টি
আটকে গেল। রানু আপু বরাবরই লাজুক প্রকৃতির। কিন্তু আজ তাকে বেশ সপ্রতিভ
লাগছে। রানু আপু বলল,' আমি শুনেছি আমেরিকা সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানকে
একটা বিশাল বড় সাইজের ঢি.ভি উপহার দিয়েছিল। আমাদের কফিল উদ্দিন স্যার
বলেছিলেন ওটাই নাকি ছিল একটা কম্পিউটার!' রেবেকা সুলতানা আপু সাথে সাথে
ওর কথার সাথে যোগ করে বললেন,'ঠিক ! ওটা ছিল বিশাল আকারের কম্পিউটার।
প্রথম দিকের কম্পিউটারের আকারগুলো বেশ বড় ছিল! মজার কথা হলো ঐ ঢাউস
সাইজের কম্পিউটারটা এখন যাদুঘরে আছে। তোমরা ঢাকা বেড়াতে এলে দেখে আসতে
পারবে।' অনু আপা এতক্ষণে মুখ খুললেন, ' দেখো! আমার উপহারের ল্যাপটপটা!
কম্পিউটারের আকার ছোট হতে হতে এখন এই ল্যাপটপে এসেছে।এখন তুমি এটাকে
নিয়ে যে কোনো জায়গায় বসে কাজ করতে পারবে! ভবিষ্যতে আরও কত কিছু যে
দেখবে তা তোমরা এখন কল্পনাও করতে পারছো না! আমি এখন ল্যাপটপ দিয়ে
পৃথিবীর তথ্যভান্ডারের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে ফেলতে পারি! জিতু সাথে
সাথে বলল, ' 'আমি কী আমার ল্যাপে ওটা রাখার সুযোগ পাব আপু!' ওর কথা শুনে
হেসে উঠল সবাই। ও দিকে রান্নাঘর থেকে মজাদার খাবারের ঘ্রাণে সবার খিদে
চাঙ্গা হয়ে উঠলো। মায়ের আদরের ডাকে সবাই মধ্যাহ্নভোজে যোগ দিল। খাবার
টেবিলে কম্পিউটারের গল্পই চলতে থাকলো। সে গল্পে রোগ দিলেন পাঁচ সন্তানের
বাবা মা লিয়াকত হোসেন ও শাকিলা রহমান।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখনকার অনেক কথা আমার বেশ ভালো মনে আছে। এখন আমি অনেক
বড়। আমার বয়স পনের। ছোটবেলার সব চেয়ে মজার স্মৃতি হলো নানা বাড়ি
দীর্ঘ এক বছর অবস্থান করা। এ সময় আমার মা পড়াশোনা করতে দেশের বাইরে
ছিলেন। ঢাকা শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে এক বছর নানা বাড়িতে কাটানোর সে
সময়টা এখনো আমার পনের বছরের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। বিশেষ করে দুপুর
বেলা খাওয়া দাওয়ার পর নানার কাছে হরেক রকম গল্প শোনার সময়টা যে কত
আনন্দের ছিল তা কাউকে বোঝাতে পারব না। নানার গল্প বলার স্টাইল ছিল
অসাধারণ। তিনি শুধু গল্প বলতেন না। গল্পের চরিত্রগুলো তিনি অভিনয় করে
দেখাতেন। কখনো রূপকথার গল্প, কখনো ছড়া বা কবিতা, কখনো ভ্রমণ কাহিনি আবার
কখনো হাসির গল্প। হাসির গল্পের মধ্যে কবি জসিমউদ্দিনের 'বাঙালি হাসির
গল্প'র কথা এখনো মনে পড়লে একা একা হাসি। কী সহজ তার ভাষা, কী চমৎকার তার
কাহিনি! আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বীরপুরুষ' কবিতা পাঠের সময় 'হা রে রে
রে, ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে'-- এ অংশটুকু আবৃত্তির সময় এত জোরে হা
রে রে রে বলে নানা অভিনয় করতেন যে আশেপাশে খালা মামারা হতচকিত হয়ে
আমাদের দেখার জন্য ছুটে আসতেন। নানুতো থরো হরি কম্পো! তারা ছুটে এসে
দেখতেন নানা নাতি হাসাহাসিতে লুটোপুটি অবস্থা!
আজ নানাকে ভীষণ মনে পড়ছে! নানার ঝুলির অনেক গল্পের মধ্যে একটা গল্পের
কারণে আজ নানার কথা ভাবছি। রূপকথার সে গল্পটা বলার সময় নানা নাতি দুজনেই
অসম্ভবকে সম্ভব করার কল্পনায় ভেসে বেড়াতাম! নানার গল্পটা ছিল ঘুটে
কুড়ানি রাজকুমারীর গল্প। গল্পের সেই ঘুটে কুড়ানি মেয়েটির দুঃখের কোনো
শেষ নেই। রাজার মেয়ে হয়েও ভাগ্যের পরিহাসে সেই রূপবতী রাজকন্যা পথে পথে
ঘুরে দিন কাটায়। একদিন ভাগ্যগুনে রাজা তাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসে।
কিন্তু রানী আর রাজকুমারী ঘুটে কুড়ানি নোংরা মেয়েটিকে একদম সহ্য করতে
পারে না। রাতের বেলা যেন ঘুটে কুড়ানি ঘুমাতে না পারে সেজন্য দু'জনে
ফন্দি বের করে। ফন্দি করে রাতের বেলা কঠিন কঠিন কাজগুলো ঘুটে কুড়ানির
জন্য ঠিক করে রাখে। সকাল বেলা কাজ না হলেই কঠির শাস্তি। এভাবেই দিন
কাটছিল ঘুটে কুড়ানির। প্রতি সকালে ওর কপালে জুটতো কঠিন শাস্তি। কিন্তু
একদিন ঘটল অবিশ্বাস্য ঘটনা। ঘুম ভেঙ্গে ঘুটে কুড়ানি দেখে সব কাজ কেউ করে
রেখেছে। সেদিন ও বেঁচে গেল মারপিটের হাত থেকে। রানী আর রাজকুমারী ওর দিকে
কটমট করে তাকিয়েই থাকলো। কেউ বুঝলো না রাতের বেলা কী করে সব কাজ শেষ
করলো ঘুটে কুড়ানি! গল্প শুনতে শুনতে নানাকে প্রশ্ন করতাম, 'নানা ঘুটে
কুড়ানির কাজগুলো কে করে দিত? ভূত?' নানা খুব রহস্য করে বলতো, ' একটা
ছবির মেয়ে কাজগুলো করে দিত। মেয়েটি দেয়ালে ছবির ফ্রেমে বসে ঘুটে
কুড়ানির কষ্ট দেখত। রাতের বেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়তো তখন চুপিসারে সব
কাজ করে আবার ছবির ফ্রেমে বন্দী হয়ে যেত। এভাবেই প্রতিদিন মারের হাত
থেকে ঘুটে কুড়ানিকে বাঁচিয়ে দিতো ছবির মেয়েটি। নানার রহস্যময় ছবির
মেয়েটি কোন্ যাদুমন্ত্রে ঘুটে কুড়ানির কষ্ট দূর করতে রাতের অন্ধকারে ওর
সব কাজ করে দিত-তা আমার ছোট্ট মাথায় কিছুতেই আসতো না। এ নিয়ে আমি অনেক
অবাস্তব স্বপ্ন দেখেছি। নানাকেও অনেক প্রশ্ন করে জ্বালাতন করেছি। কিন্তু
অদ্ভুত বিষয় হলো আমার প্রশ্ন শুনে নানা কখনো বিরক্ত হতেন না। নানা শুধু
বলতেন, ' এত শুধুই গল্প! বড় হয়ে তুমি বিজ্ঞানী হয়ে সব রহস্য উদঘাটন
করবে।' আমি পাল্টা প্রশ্ন করতাম, ' বিজ্ঞানীরা সব জানে?' এভাবেই ছবির
ফ্রেমে বাঁধা মেয়েটির রহস্য আমার কাছে অজানাই রয়ে গেল!
আজ নানা নেই। পৃথিবীতে নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার হয়েছে। ছবির
মেয়েটির রহস্য আজও রহস্য হয়েই রয়ে গেল! এ সব কল্পনা করতে করতে কখন যে
সন্ধ্যা হয়ে গেছে তা টেরই পাইনি।কল্পনার রাজ্য থেকে এবার বাস্তবে ফিরতে
হবে। ঘুটে কুড়ানির মত আমার কাজগুলো করে দেবার কেউ নেই! আজ রাতের ভিতর
আগামীকালের হোমওয়ার্ক শেষ করে নিজের সপ্তাহখানেকের এলোমেলো সব কিছু
গুছিয়ে তবেই ঘুমাতে হবে। আকাশ কুসুম কল্পনা বাদ দিয়ে এবার কাজে
ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ঠিক করে নিলাম, পড়ার টেবিলে বিজ্ঞানের টেলিস্কোপের
ছবি আঁকার হোমওয়ার্কটাই আগে সেরে ফেলি!
এরই মধ্যে বিজ্ঞান ক্লাসের স্যার চলে এলেন! আমার তো হোমওয়ার্কটা শেষ
হয়নি। সর্বনাশ! আজ আমাকে কে রক্ষা করবে? কিন্তু স্যারকে আজ অন্যরকম
লাগছে কেন? স্যারকে আমি মোটেই চিনতে পারছি না। বিজ্ঞান স্যারের চকচকে
টাকটা দেখেই আমরা তাকে চিনে ফেলি। কিন্তু আজ যাকে দেখছি তার মাথা টাকের
পরিবর্তে ঘন কালো চুলে ঢাকা। চোখে কোনো চশমা নেই। নীল নীল একটা রং
ছড়াচ্ছে চোখ দুটি। পোশাক-আশাক অনেকটা এলিয়েন টাইপের। বেশ রংচঙে এবং
ঢিলেঢালা। আমার পাশে বসা তমালকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ' তমাল ইনি কী
আমাদের বিজ্ঞানের নতুন টিচার?' তমাল বেশ ভাব দেখিয়ে বলল, ' না। এই স্যার
আমাদের কম্পিউটার সায়েন্স পড়াবেন।' আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। 'বলিস
কী' আমি তো জানতাম না।' পুরো ক্লাসের সবাই নতুন স্যারকে আগ্রহ নিয়ে
দেখছে। তাকে কেমন যেন অদ্ভুত টাইপের লাগছে আমার চোখে। ও মা, স্যার তো
সরাসরি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি তো এবার আরও অবাক! এ চেহারাটা
কোথায়ও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। এবার স্যার গম্ভীর গলায় তার নাম বললেন,
'আমার নাম রোবট নানা। আমি তোমাদের কম্পিউটার বিষয়ে পড়াবো।' কথা বলার
সময় তার মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। হঠাৎ দু'হাত ওপরে তুলে বললো, তোমরা
সবাই কেমন আছো?' কথা বলেই তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতে সবার
সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকর নাম ধরে ডাকলেন। মনে হলো তিনি যেন যুগ যুগ ধরে
ক্লাসের সবাইকে চেনেন। সবাই বেশ মজা পাচ্ছে। কিন্তু আমি কিছুটা অসহায়
বোধ করছি। আমি সরাসরি স্যারের দিকে না তাকিয়ে কাচুমাচুভাবে অন্যদিকে
দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। কিন্তু আমি যতই এড়াতে চাই ততই কম্পিউটার
সায়েন্সের এই নতুন টিচারের কাছে আমি ধরা পড়ে যাই। এক দিকে আমার
হোমওয়ার্ক হয়নি, অন্য দিকে ঘরের গোছগাছ করাও আজ জরুরি। আমি পড়েছি উভয়
সংকটে। এ সব ভাবতে ভাবতে দেখি আমার এক হাত তফাৎ এ দাঁড়িয়ে আছেন নতুন
কম্পিউটার টিচার রোবট নানা। ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লাসের সবাইকে বলল, 'আজ শুধু
পরিচয়পর্ব। আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু। তোমরা এখন বাড়ি যেতে পারো। তবে
আজ আমি রিশুদের বাড়ি বেড়াতে যাব।' আমি কিছু বলার আগেই আমার হাত ধরে
বলল,' চলো।' অগত্যা আমি তাকে নিয়ে আমার ঘরে ঢুকলাম। এতক্ষণে খেয়াল
করলাম এ টিচার খুব বেশি লম্বা না হলেও তার হাত পাগুলো বেশ লম্বা লম্বা।
তিনি চেয়ারে বসেই তার লম্বা লম্বা হাত দিয়ে আমার অগোছালো টেবিলটা বেশ
সুন্দরভাবে গুছিয়ে ফেললো। এরপর এক এক করে বিছানা থেকে শুরু করে ঘরের
মেঝে পর্যন্ত পরিস্কার করে ফেললো। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। হঠাৎ
দেখলাম আমার ব্রেকফাস্ট রেডি টেবিলে। সব কাজ শেষে তিনি বললেন,'এবার তবে
আমি আসি' - এ কথা বলে বিদায় নিতেই আমি তার পথ আটকে দাঁড়ালাম। বললাম,
তুমিই কি ফ্রেমে বাঁধা ছবির মেয়ে? তখন রোবট নানা হেসে বলল,' এখন
পৃথিবীতে আমরা এসেছি রোবট হয়ে, যাতে মানুষের কষ্ট কমে, আমরা এখন আর ছবি
নই, আমরা এখন বাস্তব। 'আমি আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার দিয়ে বললাম তাহলে
আমার নানা ঠিকই বলেছেন এক দিন অসম্ভবকে সম্ভব করবে মানুষ। আজ আমরা রোবট
দিয়ে সব কাজ করাতে পারি। আমি মাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকতে আমার ঘুম
ভেঙ্গে গেল। আমি কী ঘুমিয়ে আছি! মোবাইল বাজছে....। কানে লাগাতেই তমালের
কণ্ঠ ' তাড়াতাড়ি ক্লাসে চলে আয়, আজ আমাদের রোবট সম্পর্কে পড়াবেন নতুন
টিচার। ওনার সাথে থাকবে জলজ্যান্ত একখানা 'রোবট'। আমি হাসিমুখে বললাম,'
আসছি।'